নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৫
সকলের আবৃত্তি
আরে বলদেও, ক্যা খবর?
বলদেও। (পায়ের কাছে হাজার টাকার নোট রেখে) খবর আঁখসে দেখ্ লিজিয়ে হজরৎ।
গুরু। ভালা ভালা, দিল তো খুশ হ্যায়?
বলদেও। পহেলা তো বহুৎ ঘবড়া গিয়া থা। রাত ভর মেরে জীবাত্মানেসে হাজারো দফে বাতায়া লিয়া কি, কুছ্ নেই, কুছ নেই, ইয়ে তো শ্রেফ কাগজ হ্যায়, হাওয়াসে চলা জাতা, আগসে জ্বল্ জাতা, পানীমেসে গল্ জাতা, ইস্কো কিম্মৎ কৌড়িসে ভি কমতি হ্যায়। লিকেন আত্মারাম সারা বখৎ ঘড়বড় কর্তে থে। মেরে ঐসী বুদ্ধি লগি যে ইয়ে কাগজ তো গুরুজিকে পাঁও পর ডারনেকে লায়েক একদম নেই হ্যায়— ইস্সে দো এক রূপৈয়া ভি অচ্ছি হ্যায়। পিছে ফজিরমে দো লোটা ভর ভাঙ যব পী লিয়া, তব সব দুরস্ত হো গয়া। মেরে দিল হালকা হো গিয়া ইয়ে কাগজকা মাফিক।
গুরু। জীতা রহো বাবা, পরমাত্মা তুঝকো ভালা করে। বলো সবাই—
নোটগুলো সব ঝুটো, সব ঝুটো, সব ঝুটো—
ওরা সব খড়কুটো, খড়কুটো, খড়কুটো—
ছাই হয়ে উড়ে যাবে মুঠো মুঠো, মুঠো মুঠো, মুঠো মুঠো।
সকলের আবৃত্তি
গুরু। আজ ফকিরকে দেখছি নে যে বড়ো।
বলদেও। এক ঔরৎ ফকিরচাঁদজিকো আপনি সাথ লেকে আয়ি হ্যায়। নয়া আদমি, হমারা মালুম দিয়া কি ভিতর আকে চিল্লায়েগি— ইস্বাস্তে দোনোকো বাহার খাড়া রখ্খা হ্যায়। হুকুম মিল্নেসে লে আয়গা।
গুরু। কী সর্বনাশ! ঔরৎ! আরে নিয়ে আয়, এখ্খনি নিয়ে আয়। এইখানে একটা ভালো আসন পেতে দে, মেয়েটা হাতছাড়া না হয়!
ফকিরের সঙ্গে পুষ্পর প্রবেশ
গুরু। এসো এসো, মা, এসো। মুখ দেখেই বুঝছি, দৈববাণীর বাহন হয়ে এসেছ।
পুষ্প। ভুল বুঝছেন। আমি ছাই ফেলবার ভাঙা কুলো হয়েই এসেছি। এই আমার সঙ্গে যাকে দেখছেন, এত বড়ো বিশুদ্ধ ছাইয়ের গাদা কোম্পানির মুল্লুকে আর পাবেন না। কোনোদিন ওঁর মধ্যে পৈত্রিক সোনার আভাস হয়তো কিছু ছিল— গুরুর আশীর্বাদে চিহ্নমাত্রই নেই।
গুরু। এসব কথার অর্থ কী।
পুষ্প। অর্থ এই যে, এঁর বাপ এঁকে ত্যাগ করেছেন, ইনি ত্যাগ করতে যাচ্ছেন এঁর স্ত্রীকে। এক পয়সার সম্বল এঁর নেই। শুনেছি, আপনার এখানে সকলরকম আবর্জনারই স্থান আছে, তাই রইলেন ইনি আপনার শ্রীপাদপদ্মে।
ফকির। অ্যাঁ, এ-সব কথা কী বলছ, পুষ্পদি। ঐ তো, সোনার হারগাছা নিয়ে আসা গেল— গুরুচরণে রাখবে না?
পুষ্প। রাখব বৈকি। (গুরুর হাতে দিয়ে) তৃপ্ত হলেন তো?
গুরু। (হারখানা হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ করে) আমার অতি যৎসামান্যেই তৃপ্তি। পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং।
ফকির। ভুল করবেন না প্রভু, ওটা আমারই দান।
পুষ্প। ভুল ভাঙানো জরুরি দরকার, নইলে আসন্ন বিপদ। ওঁর বাবা বিশ্বেশ্বরবাবু পুলিসে খবর দিয়েছেন, তাঁর হার চুরি গেছে। খানাতল্লাসি করতে এখনি আসছে মখলুগঞ্জের বড়ো দারোগা দবিরুদ্দিন সাহেব।
গুরু। (দাঁড়িয়ে উঠে) কী সর্বনাশ!
পুষ্প। কোনো ভয় নেই,এখ্খনি সোনাগুলোকে ভস্ম করে ফেলুন, পুলিসের উপর সেটা প্রকাণ্ড একটা কানমলা হবে।
গুরু। (কাতরস্বরে) বলদেও!
বলদেও। (লাঠি বাগিয়ে) কুছ পরোয়া নেই, ভগবান। আপ তো পরমাত্মা হো, আপকো হুকুমসে হম লঢ়াই করেঙ্গে।
মথুর। গুরুজি, ওর ভরসায় থাকবেন না। ওর ভাঙের নেশা এখনো ভাঙে নি। লালপাগড়ি দেখলেই যাবে ছুটে। আপাতত আপনি দৌড় দিন। কী জানি, এই নোটখানা পরমাত্মার ভরসায় ওর কোন্ মনিবের বাক্স ভেঙে নিয়ে এসছে!
গুরু। অ্যাঁ, বল কি মথুর। পালাব কোথায়। ওরা যে আমার বাসার ঠিকানা জানে। এখন এই ঝুলিটা তোমরা কে রাখবে।
সকলে। কেউ না, কেউ না।
তারিণী। আমার বালা জোড়া ফিরিয়ে দাও।
গুরু। এখ্খনি, এখ্খনি। আর বলদেও, তোমার নোটখানা তুমি নাও, বাবা।
বলদেও। অব্ভি তো নেই সকেঙ্গে। পুলিস চলা জানেসে পিছে লেউঙ্গা।
পুষ্প। আচ্ছা, আমারই হাতে ঝুলিটা দিন। পুলিসের কর্তার সঙ্গে পরিচয় আছে। যার যার জিনিস সবাইকে ফিরিয়ে দেব।
মথুর। ওরে বাস্ রে, স্পাই রে স্পাই. কারও রক্ষা নেই আজ।
গুরু। স্পাই! সর্বনাশ! (উর্ধ্বশ্বাসে) চললুম আমি। মোটরটা আছে?
একজন। আছে।
ফকির। (পায়ে ধরে) প্রভো, আমি কিন্তু ছাড়ছি নে তোমার সঙ্গ।
গুরু। দূর দূর দূর। ছাড়্, ছাড়্ বলছি। লক্ষ্মীছাড়া! হতভাগা!
ফকির। তা, আমার কী দশা হবে! আমার কোথায় গতি!
গুরু। তোমর গতি গো-ভাগাড়ে।
[দ্রুত প্রস্থান]
বিপিন। মা গো, ঐ ঝুলির মধ্যে আমার আছে মোহরটা।
নিতাই। আর, আমার আছে বাজুবন্দ।
পুষ্প। এই নাও তোমরা।
সকলে। তুমিই রক্ষা করলে মা, ধড়ে প্রাণ এল।
বলদেও। মাইজি, উয়ো নোট হমকো দে দীজিয়ে। আফিস্কে বখৎমে থোড়ী দের হ্যায়।
পুষ্প। এই নাও, ঠিক জায়গায় পৌঁছিয়ে দেবে তো?
বলদেও। জরুর। পরমাত্মাজি তো ফেরার হো গয়া, দুসরা লেনেওয়ালা কোই হ্যায় নেই সওয়ায় মনিব ঔর ডাকু। মালুম থা কি নোট ভস্ম হো জায়গা, উস্কো পত্তা নহি মিলেগা, মেরা পুণ্য ঔর পুলিসকী ডাণ্ডা ফরক্ রহেগা। অভি দেখতা হুঁ কি হিসাবকি থোড়ি গলতি থী। হর হর, বোম্ বোম্।
[প্রস্থান
পুষ্প। ফকিরদা, মাথায় হাত দিয়ে ভাবছ কী। গুরুর পদধূলি তো আঠারো আনা মিলেছে। এখন ঘরে চলো।
ফকির। যাব না।
পুষ্প। কোথায় যাবে।
ফকির। রাস্তায়।
পুষ্প। আচ্ছা বেশ, ছান্দোগ্যটা তো নিয়ে আসতে হবে!
ফকির। সে আমার সঙ্গে আছে।
পুষ্প। কিন্তু, তোমার গুরু?
ফকির। রইলেন আমার অন্তরে।
পুষ্প। আর, ডিমের খোলাটা?
ফকির। সে ঝুলছে গামছায় বাঁধা বুকের কাছে।
[প্রস্থান
পুষ্প। (পিছন থেকে) সোয়মাত্মা চতুষ্পাৎ।
হৈমর প্রবেশ
পুষ্প। বিশ্বাস করতে পারিস নে বুঝি? এই নে তোর হার।
হৈম। আর, অন্যটি?
পুষ্প। এখনকার মতো চার পা তুলে সে বেড়া ডিঙিয়েছে।
হৈম। তার পর?
পুষ্প। লম্বা দড়ি আছে।
হৈম। আমার কিন্তু ভয় হচ্ছে।
পুষ্প। তুই হাঁউমাউ করিস নে তো। চতুষ্পদ একটু চরে বেড়াক-না!
হৈম। উনি ছান্দোগ্য নিয়ে যখন বেরলেন তখনি বুঝলুম, ফিরবেন না। মণ্ডূক মানে ব্যাঙ বুঝি, ভাই?
পুষ্প। হাঁ।
হৈম। উনি আজকাল বলতে আরম্ভ করেছেন, মানুষের আত্মা হচ্ছে ব্যাঙ। সেই পরম ব্যাঙ যখন অন্তরে কুড়ুর কুড়ুর করে ডাকে তখনি বোঝা যায়, সে পরমানন্দে আছে।
পুষ্প। তাই হোক-না, ওর আত্মা দেশে বিদেশে ডেকে বেড়াক, তোর আত্মা-ব্যাঙ এখন কিছুদিনের মতো ঘুমিয়ে নিক।
হৈম। মনটা যে হু হু করবে, তার চেয়ে ব্যাঙের ডাক যে ভালো।
পুষ্প। ভয় নেই, আনব তোর মাণ্ডূক্যকে ফিরিয়ে।
সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা...
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৫১-১৫৭
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪৬-১৫০
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪১-১৪৫