নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৬
তৃতীয় দৃশ্য
ষষ্ঠীচরণ। পুষ্প
ষষ্ঠী। মা, শরণ নিলুম তোমার।
পুষ্প। খবর নিয়েছি পাড়ায়, তোমার নাতি মাখন পলাতক সাত বছর থেকে— সংসারের দুনলা বন্দুক লেগেছে তার বুকে, দুঃখ এখনো ভুলতে পারে নি। একটা বিয়ে করলে পুরুষের পা পড়ে না মাটিতে, তোলা থাকে স্ত্রীর মাথার উপরে; আর, দুটো বিয়ে করলেই দুজোড়া মল বাজতে থাকে ওদের পিঠে, শিরদাঁড়া যায় বেঁকে।
ষষ্ঠী। কী না জান তুমি, মা। নবগ্রাম থেকে আরম্ভ করে মখ্লুগঞ্জ পর্যন্ত সব কটা গাঁ যে তুমি জিতে নিয়েছ। বিধাতাপুরুষ নিষ্ঠুর, তাই তোমায় মোলাম করতে হয় তাঁর শাসন।
পুষ্প। না জ্যাঠামশায় , বাড়িয়ে বোলো না। আমি মজা দেখতে বেরিয়েছি— ছুটি পেয়েছি বই পড়ার গারদ থেকে। দেখতে এলুম কেমন করে নিজের পায়ে বেড়ি আর নিজের গলায় ফাঁস পরাতে নিস্পিস্ করতে থাকে মানুষের হাত দুটো। এ না হলে ভবের খেলা জমত না। ভগবান বোধ হয় রসিক লোক, হাসতে ভালোবাসেন।
ষষ্ঠী। না মা, সবই অদৃষ্ট। হাতে হাতে দেখো-না! বড়ো বউয়ের ছেলেপুলের দেখা নেই। ভাবলেম, পিতৃপুরুষ পিণ্ডি না পেয়ে শুকিয়ে মরবেন বৈতরণীতীরে। ধরে বেঁধে দিলেম মাখনের দ্বিতীয় বিয়ে, আর সবুর সইল না, দেখতে দেখতে পরে পরে দুই পক্ষেরই কল্যাণে চারটি মেয়ে তিনটি ছেলে দেখা দিল আমার ঘরে।
পুষ্প। এবারে পিতৃপুরুষের অজীর্ণ রোগের আশঙ্কা দেখছি।
ষষ্ঠী। মা, তোমার সব ভালো, কেবল একটা বড়ো খট্কা লাগে— মনে হয়, তুমি দেবতা ব্রাহ্মণ মানই না।
পুষ্প। কথাটা সত্যি।
ষষ্ঠী। কেন মা, ঐ খুঁতটুকু কেন থেকে যায়।
পুষ্প। সংসারে দেবতাব্রাহ্মণের অবিচারের বিরুদ্ধেই যে লড়াই করতে হয়, ওদের মানলে জোর পেতুম না। সে কথা পরে হবে, আমি মাখনের খোঁজেই আছি।
ষষ্ঠী। জান তো মা, ও কিরকম হো হো করে বেড়াত— কেবল খেলাধুলো, কেবল ঠাট্টাতামাসা। ভয় হত, কোথায় কী করে বসে! তাই তো ওর গলায় একটা নোঙরের পর আর-একটা নোঙর ঝুলিয়ে দিলুম।
পুষ্প। নোঙর বেড়েই চলল, ভারে নৌকো তলিয়ে যাবার জো। আমি তোমাদের পাড়ায় এসেছি হৈমির খবর নেবার জন্যে। শুনলুম, সে তোমার এখানেই আছে।
ষষ্ঠী। হাঁ মা, এতদিন আমি ছিলুম নামেই মামা। তার বিয়ের পর থেকে এই তাকে দেখলুম। বুক জুড়িয়ে গেল তার মধুর স্বভাবে। তারও স্বামী পালিয়েছে। হল কি বলো তো! কন্গ্রেসওয়ালারা এর কিছু করে উঠতে পারলে না?
পুষ্প। মহাত্মাজিকে বললে এখনি তিনি মেয়েদের লাগিয়ে দেবেন অসহযোগ আন্দোলনে। দেশে হাতাবেড়ির আওয়াজ একেবারে হবে বন্ধ। গলির মোড়ে খুদু ময়রার দোকানে তেলে-ভাজা ফুলুরি খেয়ে বাবুদের আপিসে ছুটতে হবে— দুদিন বাদেই সিক্ লীভের দরখাস্ত।
ষষ্ঠী। ও সর্বনাশ!
পুষ্প। ভয় নেই, মেয়েদের হয়ে আমি মহাত্মাজিকে দরবার জানাব না। বরঞ্চ রবি ঠাকুরকে ধরব, যদি তিনি একটা প্রহসন লিখে দেন।
ষষ্ঠী। কিন্তু, রবি ঠাকুর কি আজকাল লিখতে পারে। আমার শ্যালার কাছে—
পুষ্প। আর বলতে হবে না। কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে দেখছি। কিন্তু ভাবনা নেই, লেখন্দাজ ঢের জুটে গেছে। দ্বাদশ আদিত্য বললেই হয়।
ষষ্ঠী। বরঞ্চ লিখতেই যদি হয়, আমি তো মনে করি, আজকাল মেয়েরা যেরকম—
পুষ্প। অসহ্য, অসহ্য। জামা শেমিজ পরার পর থেকে ওদের লজ্জা শরম সব গেছে।
ষষ্ঠী। সেদিন কলকাতায় গিয়েছিলুম; দেখি, মেয়েরা ট্র্যামে বাসে এমনি ভিড় করেছে—
পুষ্প। যে পুরুষ বেচারারা খালি গাড়ি পেলেও নড়তে চায় না। ও কথা যাক্গে— মাখনের জন্যে ভেবো না।
ষষ্ঠী। সেই ভালো, তোমার উপরেই ভার রইল।
[ষষ্ঠীর প্রস্থান]
[হৈমর প্রবেশ]
হৈম। শুনলুম তুমি এসেছ, তাই তাড়াতাড়ি এলুম।
পুষ্প। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন, তাই গান্ধারী চোখে কাপড় বেঁধে অন্ধ সাজলেন। তোমারও সেই দশা। স্বামী এল বেরিয়ে রাস্তায়, স্ত্রী এল বেরিয়ে মামার বাড়িতে।
হৈম। মন টেঁকে না ভাই, কী করি! তুমি বলেছিলে, হারাধন ফিরিয়ে আনবে।
পুষ্প। একটু সবুর করো— ছিপ ফেলতে হয় সাবধানে; একটা ধরতে যাই, দুটো এসে পড়ে টোপ গিলতে।
হৈম। আমার তো দুটোতে দরকার নেই।
পুষ্প। যেরকম দিন কাল পড়েছে, দুটো একটা বাড়তি হাতে রাখা ভালো। কে জানে কোন্টা কখন ফস্কে যায়।
হৈম। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। দেখলুম কাগজে তোমার নাম দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে—
পুষ্প। হাঁ, সেটা আমারই কীর্তি।
হৈম। তাতে লিখেছে, প্রাইভেট সিনেমায় সেতুবন্ধ নাটকের জন্যে লোক চাই, হনুমানের পার্ট অভিনয় করবে। তোমার আবার সিনেমা কোথায়।
পুষ্প। এই তো চার দিকেই চলচ্ছবির নাট্যশালা, তোমাদের সবাইকে নিয়েই।
হৈম। তা যেন বুঝলুম, এর মধ্যে হনুমানের অভাব ঘটল কবে থেকে।
পুষ্প। দল পুরু আছে ঘরে ঘরে। একটা পাগলা পালিয়েছে লেজ তুলে, ডাক দিচ্ছি তাকে।
হৈম। সাড়া মিলেছে?
পুষ্প। মিলেছে।
হৈম। তার পরে?
পুষ্প। রহস্য এখন ভেদ করব না।
হৈম। যা খুশি কোরো, আমার প্রাণীটিকে বেশি দিন ছাড়া রেখো না। ঐ কে আসছে ভাই, দাড়িগোঁফঝোলা চোহারা— ওকে তাড়িয়ে দিতে বলে দিই।
পুষ্প। না না, তুমি বরঞ্চ যাও, আমি ওর সঙ্গে কাজ সেরে নিই।
[ হৈমর প্রস্থান
সেই লোকের প্রবেশ
পুষ্প। তুমি কে?
সেই লোক। সেটা প্রকাশের যোগ্য নয় গোড়া থেকেই, জন্মকাল থেকেই। আমি বিধাতার কুকীর্তি, হাতের কাজের যে নমুনা দেখিয়েছেন তাতে তাঁর সুনাম হয় নি।
পুষ্প। মন্দ তো লাগছে না!
সেই লোক। অর্থাৎ, মজা লাগছে। ঐ গুণেই বেঁচে গেছি। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিলেই লোকের মজা লাগে। লোক হাসিয়েছি বিস্তর।
পুষ্প। কিন্তু, সব জায়গায় মজা লাগে নি।
সেই লোক। খবর পেয়েছ দেখছি। তা হলে আর লুকিয়ে কী হবে। নাম আমার শ্রীমাখনচন্দ্র। বুঝতেই পারছ, যাত্রার দলের সরকারি গোঁফদাড়ি পরে এসেছি কেন। এ পাড়ায় মুখ দেখাবার সাহস নেই, পিঠ দেখানোই অভ্যেস হয়ে গেছে।
পুষ্প। এলে যে বড়ো?
মাখন। চলেছিলুম নাজিরপুরে ইলিশ মাছ ধরার দলে। ইস্টেশনে দেখি বিজ্ঞাপন, হনুমানের দরকার। রইল পড়ে জেলেগিরি। জেলেরা ছাড়তে চায় না, আমাকে ভালোবাসে। আমি বললুম, ভাই, এদের বিজ্ঞাপনের পয়সা বেবাক লোকসান হবে আমি যদি না যাই— আর দ্বিতীয় মানুষ নেই যার এত বড়ো যোগ্যতা। এ তো আর ত্রেতাযুগ নয়!
পুষ্প। খাওয়াপরার কিছু টানাটানি পড়েছে বুঝি?
মাখন। নিতান্ত অসহ্য হয় নি। কেবল যখন ধনেশাক দিয়ে ডিমওয়ালা কই মাছের ঝোলের গন্ধস্মৃতি অন্তরাত্মার মধ্যে পাক খেয়ে ওঠে, তখন আমার শ্রীমতী বাঁয়া আর শ্রীমতী তবলার তেরেকেটে মেরেকেটে ভির্কুটি মির্কুটির তালে তালে দূর থেকে মন কেমন ধড়্ ফড়্ করতে থাকে।
পুষ্প। তাই বুঝি ধরা দিতে এসেছ?
মাখন। না না, মনটা এখনো তত দূর পর্যন্ত শক্ত হয় নি। শেষে বিজ্ঞাপনদাতার খবর নিতে এসে যখন দেখলুম, ঠিকানাটা এই আঙিনারই সীমানার মধ্যে তখন প্রথমটা ভাবলুম বিজ্ঞাপনের মান রক্ষা করব, দেব এক লম্ফ। কিন্তু, রইলুম কেবল মজার লোভে। পণ করলুম শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। দিদি আমার,কেমন সন্দেহ হচ্ছে, কোনো সূত্রে বুঝি আমাকে চিনতে, নইলে অমন বিজ্ঞাপন তোমার মাথায় আসত না।
পুষ্প। তোমার আঁচিলওয়ালা নাকের খ্যাতি পাড়ার লোকের মুখে মুখে। তোমার বিজ্ঞাপন তোমার নাকের উপর। বিশ্বকর্মার হাতে এ নাক দুবার তৈরি হতে পারে না— ছাঁচ তিনি মনের ক্ষোভে ভেঙে ফেলেছেন।
মাখন। এই নাকের জোরে একবার বেঁচে গিয়েছি, দিদি। মট্রুগঞ্জে চুরি হল, সন্দেহ করে আমাকে ধরলে চৌকিদার। দারোগা বুদ্ধিমান; সে বললে, এ লোকটা চুরি করবে কোন্ সাহসে—নাক লুকোবে কোথায়। বুঝেছ, দিদি? আমার এ নাকটাতে ভাঁড়ামির ব্যাবসা চলে, চোরের ব্যাবসা একেবারে চলে না।
পুষ্প। কিন্তু, তোমার হাতে যে কলার ছড়াটা দেখছি ওটা তো আমার চেনা, কোনো ফিকিরে তোমার জুড়ি-অন্নপূর্ণার ঘর থেকে সরিয়ে নিয়েছ।
মাখন। অনেক দিনের পেটের জ্বালায় ওদের ভাঁড়ারে চুরি পূর্বে থেকেই অভ্যেস আছে।
পুষ্প। এত বড়ো কাঁদি নিয়ে করবে কী। হনুমানের পালার তালিম দেবে?
মাখন। সে তো ছেলেবেলা থেকেই দিচ্ছি। পথের মধ্যে দেখলুম এক ব্রহ্মচারী বসে আছেন পাকুড়তলায়। আমার বদ অভ্যাস, হাসাতে চেষ্টা করলুম— ঠোঁটের এক কোণও নড়াতে পারলুম না, মন্তর আউড়েই চলল। ভয় হল, বুঝি ব্রহ্মদত্যি হবে। কিন্তু, মুখ দেখে বুঝলুম উপোস করতে হতভাগা তিথিবিচার করছে না। ওর পাঁজিতে তিনটে চারটে একাদশী একসঙ্গে জমাট বেঁধে গেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, বাবাজি, খাবে কিছু? কপালে চোখতুলে বললে, গুরুর কৃপা যদি হয়। মাঝে মাঝে দেখি মাথার নীচে পুঁথি রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্ছেন, ডাকের শব্দে ও গাছের পাখি একটাও বাকি নেই। নাকের সামনে রেখে আসব কলার ছড়াটা।
সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা...
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৫১-১৫৭
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪৬-১৫০
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪১-১৪৫