Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৮

নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

চতুর্থ দৃশ্য
নিদ্রামগ্ন ফকির। মুখের কাছে একছড়া কলা। জেগে উঠে কলার ছড়া তুলে নেড়েচেড়ে দেখল
ফকির। আহা, গুরুদেবের কৃপা। (ছড়াটা মাথায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে) শিবোহং শিবোহং শিবোহং। (একটা একটা করে গোটা দশেক খেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে) আঃ!
মাখনের প্রবেশ
মাখন। কী দাদা, ভালো তো! আমার নাম শ্রীমাখনানন্দ।
ফকির। গুরুর চরণ ভরসা।
মাখন। গুরুই খুঁজে মরছি। সদ্গুরু মেলে না তো। দয়া হবে কি। নেবে কি অভাজনকে।
ফকির। ভয় নেই, সময় হোক আগে।
মাখন। (কান্নার সুরে) সময় আমার হবে না প্রভু, হবে না। দিন যে গেল! বড়ো পাপী আমি। আমার কী গতি হবে।
ফকির। গুরুপদে মন স্থির করো— শিবোহং।
মাখন। এই পদেই ঠেকল আমার তরী; যম তা হলে ভয়ে কাছে ঘেঁষবে না।
ফকির। তোমার নিষ্ঠা দেখে বড়ো সন্তুষ্ট হলুম।
মাখন। শুধু নিষ্ঠা নয় গুরু, এনেছি কিছু তালের বড়া। তালগাছটা সুদ্ধ উদ্ধার পাক।
ফকির। (ব্যগ্রভাবে আহার) আহা, সুস্বাদ বটে। ভক্তির দান কিনা।
মাখন। সার্থক হল আমার নিবেদন। বাড়ির এঁয়োরা খবর পেলে কী খুশিই হবেন! যাই, ওঁদের সংবাদ পাঠিয়ে দিইগে, ওঁরা আরও কিছু হাতে নিয়ে আসবেন।— প্রভু, গৃহাশ্রমে আর কি ফিরবেন না।
ফকির। আর কেন। গুরু বলেন, বৈরাগ্যং এবং ভয়ং।
মাখন। গৃহী আমি, ডাইনে বাঁয়ে মায়া-মাকড়সানি জড়িয়েছে আপাদমস্তক। ধনদৌলতের সোনার কেল্লাটা কত বড়ো ফাঁকি সেটা খুব করেই বুঝে নিয়েছি। বুঝেছি সেটা নিছক স্বপ্ন। ভগবান আমাকে অকিঞ্চন করে পথে পথে ঘোরাবেন এই তো আমার দিনরাত্রির সাধনা, কিন্তু আর তোর পারি নে, একটা উপায় বাতলিয়ে দাও।
ফকির। আছে উপায়।
মাখন। (পা জড়িয়ে) বলে দাও, বলে দাও, বঞ্চিত কোরো না।
ফকির। দিন-ভোর উপোস ক’রে থেকে—
মাখন। উপোস! সর্বনাশ! সেটা অভ্যেস নেই একেবারেই। আমার দুষ্ট গ্রহ দিনে চারবার করে আহার জুটিয়ে দিয়ে অন্তরটা একেবারে নিরেট করে দিয়েছেন। আর কোনো রাস্তা যদি—
ফকির। আচ্ছা, দুখানা রুটি—
মাখন। আরও একটু দয়া করেন যদি, দুবাটি ক্ষীর!
ফকির। ভালো, তাই হবে।
মাখন। আহা, কী করুণা প্রভুর! তেমন করে পা যদি চেপে থাকতে পারি তা হলে পাঁঠাটাও—
ফকির। না না, ওটা থাক্।
মাখন। আচ্ছা, তবে থাক্, একটা দিন বৈ তো নয়। তা কী করতে হবে বলুন। দেখুন, আমি মুখ্খু মানুষ, অনুস্বার-বিসর্গওয়ালা মন্তর মুখ দিয়ে বেরবে না, কী বলতে কী বলব, শেষকালে অপরাধ হবে।
ফকির। ভয় নেই, তোমার জন্যে সহজ করেই দিচ্ছি। গুরুর মূর্তি স্মরণ করে সারারাত জপ করবে, সোনা তোমাকেই দিলুম, তোমাকেই দিলুম, যতক্ষণ না ধ্যানের মধ্যে দেখবে, সোনা আর নেই—কোত্থাও নেই।
মাখন। হবে হবে প্রভু, এই অধমেরও হবে। বলব, সোনা নেই, সোনা নেই; এ হাতে নেই, ও হাতে নেই; ট্যাঁকে নেই, থলিতে নেই; ব্যাঙ্কে নেই, বাক্সোয় নেই। ঠিক সুরে বাজবে মন্ত্র। আচ্ছা, গুরুজি, ওর সঙ্গে একটা অনুস্বার জুড়ে দিলে হয় না? নইলে নিতান্ত বাংলার মতো শোনাচ্ছে। অনুস্বার দিলে জোর পাওয়া যায়— সোনাং নেই, সোনাং নেই, কিছুং নেই, কিছুং নেই।
ফকির। মন্দ শোনাচ্ছে না।
মাখন। আচ্ছা, তবে অনুমতি হোক, পোলাওটা ঠাণ্ডা হয়ে এল!
[প্রস্থান]
ফকিরের গান
শোন্ রে শোন্ অবোধ মন—
শোন্ সাধুর উক্তি, কিসে মুক্তি
সেই সুযুক্তি কর্ গ্রহণ।
ভবের শুক্তি ভেঙে মুক্তি-মুক্তা কর্ অন্বেষণ
ওরে ও ভোলা মন!
ষষ্ঠীচরণ ছুটে এসে
ষষ্ঠী। দেখি দেখি, এই তো দাদু আমার— আমার মাখন। (মুখে হাত বুলিয়ে) অমন চাঁদমুখখানা দাড়ি গোঁফ দিয়ে একেবারে চাপা দিয়েছে। একে ভগবান আমার চোখে পরিয়েছে বুড়ো বয়সের ঠুলি, ভালো দেখতেই পাই নে, তার উপর এ কী কাণ্ড করেছিস মাখন!
ফকির। সোহং ব্রহ্ম, সোহং, ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।
ষষ্ঠী। করেছিস কী দাদু, মন্তর প’ড়ে প’ড়ে অমন মিষ্টি গলায় কড়া পাড়িয়ে দিয়েছিস! সুর মোটা হয়ে গেছে!
ফকির। শিবোহং শিবোহং শিবোহং।
বামনদাস বাবুর প্রবেশ
বামনদাস। আরে আরে, আমাদের মাখন নাকি ? খাঁটি তো? ও ষষ্ঠীদা, মানতেই হবে যোগবল— নাকের উপর থেকে আঁচিলটা একেবারে সাফ দিয়েছে উড়িয়ে। ভট্চায, দেখে যাও হে, নাকের উপর কী মন্তর দেগেছিল গো! একটু চিহ্ন রেখে যায় নি। ষষ্ঠীদা, ঐ নাক নিয়ে কত ঝাড়ফুঁক করেছিলে, একটু টলাতে পার নি। তপিস্যের মাহাত্মি বটে—
ষষ্ঠী। না ভাই, মাহাত্মি ভালো লাগছে না। তোরা যাকে বলতিস গণ্ডারী নাক, সে ছিল ভালো।
নিশিঠাকুর। ওর মুখমণ্ডল যে নিজেকে বেকবুল করছে, তার উপরে আবার মুখে কথা নেই। অমন সব বোলচাল, মুনি হয়ে সব ভুলেছে বুঝি!
ভজহরি। দেখি দেখি মাখ্না, মুখটা দেখি। (চিমটি কেটে, চামড়া টেনে) না হে, এ মুখোষ নয়, ধাঁদা লাগিয়ে দিলে।
নিতাই। কিনু, দেখ্ তো টেনে ওর দাড়িগোঁফ সত্যি কি না।
ফকির। উঃ উঃ!
চণ্ডী। (পিঠে কিল মেরে) কেমন লাগল।
ফকির। উঃ!
চণ্ডী। ঐ তো, সন্ন্যাসীর সুখদুঃখবোধ আছে তো! মাথায় হুঁকোর জল ঢালি তবে, মাথা ঠাণ্ডা হোক।
ষষ্ঠী। আহা, কেন ওকে বিরক্ত করছ, ভাই। সাত বছর পরে ফিরে এল, সবাই মিলে আবার ওকে তাড়াবে দেখছি। মাখন, ও ভাই মাখন, আর দুখ্খু দিস্ নে— একটা কথা ক, নাহয় দুটো গাল দিলিই বা!
ফকির। আপনারা আমাকে মাখন বলে ডাকছেন কেন। পূর্ব-আশ্রমে আমার যে নাম থাক্, আমার গুরুদত্ত নাম চিদানন্দ স্বামী।
সকলের উচ্চহাস্য
চিনু। ওরে বাবা, ত্রাণকর্তা এলেন আমাদের। দেখ্ মাখ্না, ন্যাকামি করিস নে। ভাবছিস, এমনি করে আবার ফাঁকি দিয়ে পালাবি! সেটি হচ্ছ না; তোর দুই বউয়ের হাতে দুই কান জিম্মে করে দেব, থাকবি কড়া পাহারায়।
ফকির। গুরো, হায় গুরো!

সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।