Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৯

নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

[দুই স্ত্রীর প্রবেশ]
১। ঐ যে গো, মুখ চোখ বদলিয়ে এসেছেন আমাদের কলির নারদ।
ফকির। মা, আমি তোমাদের অধম সন্তান, দয়া করো আমাকে।
সকলে। এই এই, করলে কী! প্রাণের ভয়ে মা বলে ফেললে?
১। ও পোড়াকপালে মিন্সে, তুই মা বলিস কাকে!
২। চোখের মাথা খেয়ে বসেছিস, তোর মরণ হয় না!
ফকির। একটু ভালো করে আমাকে দেখে নিন।
১। তোমাকে দেখে দেখে চোখ ক্ষয়ে গেছে। তুমি কচি খোকা নও, নতুন জন্মাও নি। তোমার দুধের দাঁত অনেকদিন পড়েছে, তোমার বয়সের কি গাছ পাথর আছে। তোমায় যম ভুলেছে বলে কি আমরাও ভুলব।
২। (নাক মুচ্ড়িয়ে দিয়ে) সাক্ষীকে বিদায় করেছ নাকের ডগা থেকে। তাই বলে আমাদের ভোলাতে পারবে না— তোমার বিট্লেমি ঢের জানা আছে। ওমা, ওমা, ঐ দেখ্ লো ছুট্কি— সেই তালের বড়ার ধামাটা।
১। তাই রাত্তিরে গিয়েছিলেন ভূত সেজে বড়া খেতে!
২। চক্কোত্তিমশায়, এই দেখে নাও— মিন্সে রান্নাঘরে ঢুকে এনেছে বড়াসুদ্ধ আমাদের ধামা চুরি করে।
সকলের হাস্য
কানু মণ্ডল। সে কি হয়। যোগবল, ভাঁড়ার থেকে উড়িয়ে এনেছে।
ষষ্ঠী। ওগো বউদিদিরা, কেন ওকে খোঁটা দিচ্ছ। ঘরের বড়া ঘরের মানুষই যদি নিয়ে এসে থাকে তাকে কি চুরি বলে।
১। ভালোমান্ষের মতো যদি নিত তবে দোষ ছিল না— মা গো, সে কী দাঁতখিঁচুনি। আমার তো দাঁতকপাটি লেগে গেল।
ষষ্ঠী। ভাই মাখন, এটা তো ভালো কর নি— গোপনে আমাকে জানালে না কেন। তালের বড়ার অভাব কী।
ফকির। গুরো!
২। (কলার ছড়ার বাকি অংশ তুলে ধ’রে) এই দেখো তোমরা। ভাঁড়ারে রেখেছিলুম ব্রাহ্মণভোজন করাব ব’লে। সকালে উঠে আর দেখতে পাই নে। দরজাও খোলা নেই, ভয়ে মরি। আমাদের এই মহাপুরুষের কীর্তি। কলা চুরি করে ধর্মকর্ম করেন!
ষষ্ঠীচরণ। (মহাক্রোধে) দেখো, এ আমি কিছুতেই সইব না। এই ডাইনি দুটোকে ঘর থেকে বিদায় করতে হবে, নইলে আমার মাখনকে টেঁকাতে পারব না। দেখছ তো, মাখন? কেবল ভালোমান্ষি করে দুই বউকে কী রকম করে বিগ্ড়িয়ে দিয়েছ!
ফকির। সর্বনাশ! আপনারা সাংঘাতিক ভুল করছেন। আপনাদের সকলের পায়ে ধরি— আমাকে বাঁচান! হে গুরো, কী করলে তুমি।
ষষ্ঠী। না ভাই, বেকবুল যেয়ো না। ধামাটা তুমি ওদের ঘর থেকে এনেছিলে, কলার ছড়াটাও প্রায় নিকেশ করেছ। সেটাতে তোমার অপরাধ হয় নি— তবে লজ্জা পাচ্ছ কেন।
ফকির। দোহাই ধর্মের, দোহাই আপনাদের— আমি ধামাও আনি নি, কলার কাঁদিও আনি নি।
ষষ্ঠী। পষ্টই দেখা যাচ্ছে খেয়েছ তুমি। কেন এত জিদ করছ।
ফকির। খেয়েছি, কিন্তু—
বামনদাস। আবার কিন্তু কিসের!
ফকির। আমি আনি নি।
সকলের হাস্য
পাঁচু। তুমি খাও তালের বড়া, দেয় এনে আর-এক মহাত্মা, এও তো মজা কম নয়। তাকে চেন না?
ফকির। আজ্ঞে না।
সিধু। সে চেনে না তোমাকে?
ফকির। আজ্ঞে না।
নকুল। এ যে আরব্য উপন্যাস।
সকলের হাস্য
ষষ্ঠী। যা হবার তা তো হয়ে গেছে, এখন ঘরে চলো।
ফকির। কার ঘরে যাব?
১। মরি মরি, ঘর চেন না পোড়ারমুখো! বলি, আমাদের দুটিকে চেন তো?
ফকির। সত্যি কথা বলি, রাগ করবেন না, চিনি নে।
সকলে। ঐ লোকটার ভণ্ডামি তো সইবে না। জোর করে নিয়ে যাও ওকে ধরে তালা বন্ধ করে রাখো।
ফকির। গুরো!
সকলে। মিলে ঠেলাঠেলি ওঠো, ওঠো বলছি।
সুধীর। বউ দুটোকে এড়াতে চাও তার মানে বুঝি; কিন্তু তোমার ছেলেমেয়েগুলিকে? তোমার চারটি মেয়ে, তিনটি ছেলে, তাও ভুলেছ না কি।
ফকির। ও সর্বনাশ! আমাকে মেরে ফেললেও এখান থেকে নড়ব না। (গাছের গুঁড়ি আঁকড়িয়ে ধ’রে) কিছুতেই না।
হরিশ উকিল। জান আমি কে? পূর্ব-আশ্রমে জানতে। অনেক সাধুকে জেলে পাঠিয়েছি। আমি হরিশ উকিল। জান? তোমার দুই স্ত্রী!
ফকির। এখানে এসে প্রথম জানলুম।
হরিশ। আর, তোমার চার মেয়ে তিন ছেলে।
ফকির। আপনারা জানেন, আমি কিছুই জানি নে।
হরিশ। এদের ভরণপোষণের ভার তুমি যদি না নাও, তা হলে মকদ্দমা চলবে বলে রাখলুম।
ফকির। বাপ রে! মকদ্দমা! পায়ে ধরি, একটু রাস্তা ছাড়ুন।
দুই স্ত্রী। যাবে কোথায়, কোন্ চুলোয়, যমের কোন্ দুয়োরে?
ফকির। গুরো! (হতবুদ্ধি হয়ে বসে পড়ল)
হৈমবতীর প্রবেশ ও ফকিরকে প্রণাম
ফকির। (লাফিয়ে উঠে) এ কী, এ যে হৈমবতী! বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।
১। ওলো, ওর সেই কাশীর বউ, এখনো মরে নি বুঝি!
মাখনকে নিয়ে পুষ্পর প্রবেশ
মাখন। ধরা দিলেম— বেওজর। লাগাও হাতকড়ি। প্রমাণের দরকার নেই। একেবারে সিধে নাকের দিকে তাকান। আমি মাখনচন্দ্র। এই আমার দড়ি আর এই আমার কল্সি। মা অঞ্জনা, কিষ্কিন্ধ্যায় তো ঢোকালে। মাঝে মাঝে খবর নিয়ো। নইলে বিপদে পড়লে আবার লাফ মারব।
পুষ্প। ফকিরদা, তোমার মুক্তি কোথায় সে তো এখন বুঝেছ?
ফকির। খুব বুঝেছি— এ রাস্তা আর ছাড়ছি নে।
পুষ্প। বাছা মাখন, তোমার মস্ত সুবিধে আছে— তোমার ফুর্তি কেউ মারতে পারবে না। এ দুটিও নয়।
দুই স্ত্রী। ছি ছি, আর একটু হলে তো সর্বনাশ হয়েছিল! (গড় হয়ে প্রণাম ক’রে) বাঁচালে এসে।

—শেষ—

সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।