Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

shit o kuyasha series

shit o kuyasha series

শীত ও কুয়াশা সিরিজ : সমীর আহমেদ

শীত ও কুয়াশা সিরিজ
সমীর আহমেদ

ক্রমশ একটি থেকে আরেকটি শূন্য গহ্বরে ডুবে যেতে যেতে ভাবি,
নিজেকে কোথাও কি ফেলে এসেছি? জোছনোজ্জ্বল পথে নালন্দার
মাঠে এঁকে গেছে কারা স্বপ্ন-সবুজ শস্যের মানচিত্র? আজও করি
তাঁদের খোঁজ। সমুদ্র-ঢেউয়ের সব আকুলতা বুকে নিয়ে বিচ্ছিন্ন
দ্বীপের মতো জেগে আছি। কোনো কোনো ঢেউ হয়তো একদিন
ছুঁয়ে ফেলে বহু প্রতীক্ষিত বেলাভূমি। আমারই কেবল যাওয়া হয়
না কোথাও। পুরনো অ্যালবামে নড়ে-চড়ে ওঠে এক বিষণ্ন ছায়া।
দু’ পায়ে জড়িয়ে আছে সরিষার রেণু। জানি না কতোটা পথ
হেঁটেছে সে; আরও যেতে চায় কতোটা দূর। তার মতো তুমিও
কি আজও জেগে আছো এই কুয়াশা-হিম অন্ধকারে, ভেঙে যাওয়ার
আগে সমুদ্র-ঢেউয়ের সব আকুলতা নিয়ে?

শীত ও কুয়াশা কী নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রাখে ঘাসের শরীর! আমি বুঝিনি;
প্রতিদিন এই সব মায়াবী ঘাস পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছি তোমাদের বাড়ি।
দেখেছি শীতের হাওয়া খেলা শেষে ফেলে গেছে শূন্য উঠোন। অবুঝ ঘাসের
মতো আবিষ্ট হয়ে নিবিড় আলিঙ্গন পেতে তুমি অপেক্ষায় নেই। বুকের
ভেতরে কাঁপন দিয়ে শীত দু’চোখে রেখে গেছে কুয়াশার ভিড়। হিমযুগ
পার হয়ে তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো রৌদ্রোজ্জ্বল মৃতদের শহরে।

ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে আমাদের গ্রাম। দেখি না চুলার পাড়ে লালচে
আগুনের আঁচে বউ-ঝি, মা-চাচিদের উজ্জ্বল মুখ। শুনি না মা’র মধুর
আহ্বান, ‘ও বাজান, আয়, পিঠা খাইয়া যা।’ শীতের বাতাস থেকে গোপনে
উড়ে গেছে রসের পিঠা, পাটিসাপটা, ভাপাপিঠা, হাতেকাটা সই আর
খেজুরগুড়ের ঘ্রাণ। এসব এখন নিয়েছে দখল নগর ফুটপাতের ধূলোবালি,
বিষাক্ত বাতাস। পুঁজিবাদী বহুমুখি বিপণী বিতানের দম বন্ধ করা কাচের
ঘরে কিছু পিঠা মুমূর্মু রোগীর মতো ঘুমায়। যেদিকে তাকাই শুধুই নগর।
শীতের সকালের রোদে দেখি না উঠোনে মায়ের ছায়া। গাঢ় কুয়াশা ঢেকে
দিছে আমাদের গ্রাম। ‘ও মা, মা গো! তুমি কোথায়?’ বড়ঘর থেকে তোমার
কণ্ঠস্বর কি আর কোনোদিন শুনতে পাবো না, ‘ও বাজান, আয়, পিঠা খাইয়া
যা।’ এবারও বিফলে যাবে আমার শীতকাল—তোমার হাতের পিঠা বিহীন!
করুণ কুয়াশাচোখে তাকিয়ে থাকে তোমার কবরের লতাপাতা-ঘাস!

তোমার বিরহে কুয়াশায় রেখেছি জমা গোপন সন্তাপ। কুয়াশা
কেটে গেলে দেখি প্রাচীন নগরীর বীভৎসতা নিয়ে জেগে উঠছো
তুমি। কোথায় তোমার ভালোবাসা? শীত না ফুরাতেই পরিযায়ী
পাখির মতো উড়াল দিছে সাইবেরিয়ার দিকে। সামনে শুধু চৈত্রের
দীর্ঘ খরাতপ্ত দিন। জমিনে নামিয়েছো কলের লাঙল। হাইব্রিড
শস্যে এবার ভরে যাবে গোলা। অবহেলায়, অভিমানে গরুশূন্য
গোয়ালঘরের কোণে ঝিমায় আমার সাধের লাঙল। ভাদ্রের
অপেক্ষায় বেওয়ারিশ কুকুরের মতো আমি থাকি চুপ। কলের লাঙল
কি বোঝে শস্যবতী মাটির মর্ম! নাকি স্বপ্ন দেখে সুখ পায় সোনার
শস্যের! সে শুধু যান্ত্রিক যাতনায় ফালা ফালা করে তোমার জমিন।
গোপনে ফালা ফালা হয় শুধু আমার কোমল বুক।

মা বাড়িতে যেতে বলে। যাবো যাবো করে আমারই শুধু দেরি হয়ে
যায়। এবার শীতে যখন বাড়িয়েছি পা, চারদিকে জমেছে ঘন কুয়াশা।
মৃতদের শহর ছেড়ে যেতে চাই গ্রামে—মায়ের কাছে। কিন্তু শহর
আমাকে ছাড়ে না। আমাকে যেন পেয়ে বসেছে হিরাঝিলের গোলক
ধাঁ ধাঁ। বারবার ঘুরে ফিরে দেখি জন্মান্ধ শহরের অলিগলি।
তারপর যখন যাত্রা করি গ্রামের দিকে, গোটা শহর ডায়নোসরের
মতো আগুন চোখে ছুটে আসে আমার পেছনে। আমি দৌড়ে মাঠের
পর মাঠ পার হই, শহর থামে না। খাল-বিল-নদী পার হই, শহর
ছুটে আসে ভয়ঙ্কর দৈত্যের মতো। মাকে ডাকতে ডাকতে আমি
এগিয়ে যাই সামনে, আরও সামনে; নাকি পেছনে? বুঝতে পারি না।
মাঠের পর মাঠ ক্রমশ ছোট হয়ে আসে, নদীর পর মরা নদী,
খালের পর শুকনো খাল, বিলের পর শুকনো বিল, পথের পর
পাকা সড়ক; চারপাশের সবকিছু কেন এতো অচেনা লাগে?
কোথাও আমার বাস্তুভিটা চোখে পড়ে না। কোন গাঁয়ে ঘর আমার?
কোথায় বাড়ি? আমার সেই গাঁয়ের ঠিকানা কি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি!

যেন জন্ম থেকেই ছুটছি তোমার দিকে। দেখেছি কাঠে কাঠ কিংবা শিলায়
শিলায় আগুন জ্বেলে মানুষ কীভাবে পোড়ায় হৃদয়ের সুখ। বরফ-পাথর যুগ
পার হয়ে আরও নিষ্ঠুরতায় হাতে তুলে নেয় ইসপাত, লোহা ও বারুদ।
এসব উপেক্ষা করে ডিজিটাল নগরে খুঁজি তোমার মায়াবী মুখ। কুয়াশার
প্রগাঢ় প্রলেপ ভেদ করে তুমি রয়েছো দাঁড়িয়ে। তুমুল আবেগে স্পর্শ করে
বুঝি, তুমি এক পাথর-প্রতিমা।

সব ঢেউ নিয়েছি নদীর, আমার কিছু দিয়েছি তার জলে
নদী বলে, ‘আমাকে পোড়াইও না আর এই জলের অনলে।’
কিছু ব্যথা রেখেছি গোপন, সুখটুকু গেঁথেছি পাখির পালকে,
পাখি বলে, ‘আমি এবার উড়াল দেবো ওই দূর সুনীললোকে।’
কাঁটাগুলো রেখেছি এ বুকে, ফুলগুলো দিয়েছি তোমায়,
ফুল বলে, ‘তোমাকে পোড়ায় যে, তারে তুমি রাখো ক্ষমায়!’
তোমার গরল গিলে তোমাকেই দিয়ে যাই বিশুদ্ধতা,
তবু চাই ফুলে-ফলে, সৌরভে-গৌরবে তোমার ঋদ্ধতা।
আলো-অন্ধকারে খেলা জমিয়ে তুমি থাকো চুপ,
কুয়াশায় মুড়িয়ে রাখো তোমার গোপন রূপ।

আজ সেই অশ্বারোহীরা নেই। তাদের দুর্দান্ত তেজী ঘোড়াগুলোও
চরে না কোথাও। কিন্তু সন্ধ্যার গোধূলিতে ধূলো উড়িয়ে, রাত্রির গাঢ়
অন্ধকারে কাফনশাদা কুয়াশা ভেদ করে ঘোড়াগুলোর খুরের অবিরাম
খট খট শব্দ ভেসে আসে কানে। ভয়ে বুক হিম হয়ে যায়। এই ডিজিটাল
প্রত্নমাঠ পেরিয়ে ঘোড়াগুলো আবার ছুটেছে কোথায়? নাকি অশ্বারোহীরা
অদৃশ্য হলেও তাদের পায়ের শব্দ পৃথিবীতে চিরকাল থেকে যায়!

একটি গিরিখাত বেয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠে আসে কবি ।
সামনে শুধুই এক পাথর উদ্যান। প্রতিটি পাথরে উদ্গত সবুজ
থেকে সুফলা শস্যের দিকে হেঁটে যায় তার অদম্য স্বপ্ন।
কোথা থেকে ভেসে আসে এতো গোলাপের ঘ্রাণ! কেবল
কবিই জানে, রোদ-বৃষ্টিস্নাত শ্যাওলা ধরা কঠিন পাথরে
একদিন ফুটে উঠবে মনোরম ঘাসফুল আর সুবাসিত গোলাপ বাগান।

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।