সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
রাত ধীরে নামে মাটিতে…
ঘরে চাল নেই—
অতএব আজ আমাদের উপোস
হাওয়া বয়, গায়ে জ্বালা দেয়—
রাতের আকাশ তারায় তারায় ছাওয়া
চোখে যন্ত্রণা দেয়
ক্ষুধার্তের এসব বিলাস থাকে না…
মনে হয়—
ভাত ছাড়া বেঁচে থাকবার কোনো অর্থ নেই!
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
দুই
হৈ হৈ করে খিদে পেল
পেটের জ্বালা আগুন…
ভাতের স্বপ্নে রূপালি উল্লাস
চোখ ফেটে পড়ে বন্যতায়
শরীরে নেমে আসে ঘুম
অস্থিরতা শিকড়ে অস্থির
লুটে নেবার ব্যর্থ হাহাকার
শ্বাসমূলে জমাট প্রশ্বাস…
কাদামাটির মতো ক্ষুধা ধুতে চাই—
তবু পেট থেকে ক্ষুধা যায় না!
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
তিন
উপবাসে মা’র চোখে
অঝোরে জল ঝরে…
মা একদম খিদে সহ্য করতে
পারে না—
তবু খিদের কোনো করুণা নেই…
অভুক্তকে সে আরো জোরে আঘাত করে—
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
চার
চাল আছে, চুলো নেই
এমন আশ্চর্য অবস্থা আমার…
দেনা বাড়ে, দিনে দিনে ঋণ
অস্তগামী প্রাণ ক্ষয়ে যায়—
ভেতরে-বাইরে, শত্রু-মিত্রের উপহাস
অন্ধকার পথ। আগামী দিন দুর্গম
হাঁটি হাঁটি যাত্রাপথে কাঁটা…
চতুর্দিকে অন্ধকার,
অন্ধকার এ-ঘর ও-ঘর!
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
পাঁচ
খিদের জন্য গাছে পাতা কাঁপে
হাওয়া দোলায় শব্দ ওঠে
এক অব্যক্ত কান্নায় ভিজে ওঠে চরাচর!
খিদের জন্য ক্ষুধার্ত মানুষ খুব কষ্ট পায়।
বিদ্রোহ করে, প্রকাশ্যে কেঁদে ফেলে
চোখ মোছে, তাকায় আগুন…
খিদের জন্য ক্ষোভ, যোদ্ধার মতন আত্মসম্মান
এই বোধ থেকেই জন্মায়
একটা জেদ শিরদাঁড়ার চারপাশে
গাছের ডালের মতো খ্যাপা, একরোখা…
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
ছয়
এবার ভাত খাওয়ার সময়
এইটুকু আনন্দ, এইটুকু পুঁজি—
পেটে আগুন দাউ দাউ জ্বলছে
একমুঠো ভাত কষ্টের অর্জন…
চারদিকে অভুক্তের শীৎকার
কাম কাম গন্ধে ভোগের আস্বাদ
লুটে নেবার অনুভূতি প্রবল…
ভাতের জন্য সবার প্রাণপাত—
ভাত-ই অভুক্তের কাছে ঈশ্বর!
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
সাত
চাকার মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আসে ক্ষুধা
রাত—সারারাত কাদের অন্ন-উৎসব?
ক্ষুধার্ত দু’টি মানুষ সঙ্গোপনে শিকারি…
দুজনের দিকে তাদের অস্ত্র ছুঁড়ে দেয়—
এই তাদের যুদ্ধ, মহিমান্বিত আহ্লাদ…
একদা অন্তরঙ্গ, সশ্রদ্ধ, পরস্পর আহার!
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
আট
একজন ক্ষুধার্ত মানুষ
খাদ্য ছাড়া কিছু বোঝে না—
তার কাছে ঘর-বাড়ি
স্মৃতি-প্রীতি সব অহেতু…
তার কাছে সুন্দর-অসুন্দর
ফুল, পাখি, নদী
—সব বিরক্তির কাঁটা…
একমুঠো ভাত ছাড়া
তার কোনো উপাস্য নেই!
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
নয়
ক্ষুধা না-থাকলে শূন্যে আগুন
কখনো আবিষ্কার হতো না,
হতো না চাকার মতো গতি…
প্রতিরাতে কত কত নক্ষত্র
ক্ষুধার হিল্লোলে কেঁপে ওঠে
চাঁদ কাঁপে, মেঘ কাঁপে, বাতাসও…
ক্ষুধার জন্যই ঝরেছে শিশির!
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
দশ
খিদের জন্যই পৃথিবী সুন্দর—
আমি তোমাকে খাই
তুমিও আমাকে খাও
পরিপূরক নিয়মে…
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
এগারো
টাকার জন্য সারাবেলা খাটি
সারাবেলা ভাতের জন্য লড়াই
ক্ষুধা আর অভাবে
শিরদাঁড়া উঁচু রাখার চেষ্টা করি—
ভাবি, টাকা নেই—
থাকলে জীবনে আরো খানিকটা
সুন্দর বাঁচা হতো!
সুনীল শর্মাচার্য : ক্ষুধাগুচ্ছ
বারো
জানালার বাইরে পৃথিবীটা দেখি খুব সুন্দর—
গ্রামগঞ্জ, শহর যখন রাতে নিঃশব্দে ঘুমোয়
তখন মাঝে মাঝে জানালা খুলে দেখি—
একটা লোক আপন মনে ক্ষুধা কুড়িয়ে বেড়াচ্ছে
আমি ডিকশনারির পাতা ওল্টাই
আর ক্ষুধা তাড়ানোর মন্ত্র খুঁজি…
……………………………………………………………….
১১৫ thoughts on “সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ”