বাঁধনহারা : কাজী নজরুল ইসলাম : ৪
তারপর, ওরে ছ্যাঁচা ঝিনুক! তুই যে অত করে নিজকে লুকিয়ে রাখতে চাস সমুদ্দুর, না ডোবার ভিতরে, কিন্তু পারবি কি! আমি যে এঁটেল ‘লটে-ছ্যাঁচড়’ ডুবুরি! তুই পারস্যোপকূলের সমুদ্রের পাঁকে গিয়ে লুকোলেও এ ডুবুরির হাত এড়াতে পারিবি নে, জেনে রাখিস। মানিক কি কখনও লুকানো যায় রে আহাম্মক? খোশবুকে কি রুমাল চাপা রাখা যায়?… হায় কপাল, এই কুড়ি-একুশ বছর বয়সে তোর মতো উদাসীনরা আবার সংসারের কী বুঝবে? শুধু কবির কল্পনায় তোরা সংসারকে ভালোবাসিস, এখানের যা কিছু ভালো, যা কিছু সুন্দর কেবল তাই তোদের স্বচ্ছ প্রাণে প্রতিফলিত হয়, তাই তোদের সঙ্গে আমাদের দুনিয়াদার লোকের কিছুতেই পুরোমাত্রায় খাপ খায় না। এক জায়গাতে একটু ফাঁক থাকবেই থাকবে, তা আমরা যতই মিশ খাওয়াতে চেষ্টা করি না! কারণ, বড়ো কঠিনভাবে দুনিয়ার—বাস্তব জগতের নিষ্ঠুর সত্যগুলো আমাদের হাড়ে হাড়ে ভোগ করতে হয়! তোরা কল্পনারাজ্যের দেবশিশু, বনের চখা-হরিণ, আর আমরা, বাস্তব জগতের রক্ত-মাংসে-গড়া মানব, খাঁচার পাখি!—এইখানেই যে ভাই মস্ত আর আদত বৈষম্য!
কোনো ফরাসি লেখক বলেছেন যে, খোদা মানুষকে বাক্শক্তি দিয়েছেন শুধু মনকে গোপন করবার জন্যে। আর এ একেবারে নিরেট সত্য কথা। তাই আমার কেন মনে হচ্ছে যে, তুই বাইরে এত সরল, এত উদার, এমন শিশু হয়েও যেন কোন্ এক বিপুল ঝঞ্ঝা, কী একটা প্রগাঢ় বেদনার প্রচ্ছন্ন বেগ অন্তরে নিয়তই চেপে রাখছিস!—মানুষকে বোঝা যে বড্ড শক্ত ব্যাপার, তা জানি, কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের চোখে ধুলো দেওয়াও নেহাত সহজ নয়। তোদের মতো লোককে চিনতে পারেন এক তিনিই, যিনি নিজের বুকে বেদনা পেয়েছেন; আর সেই বেদনা দিয়ে যদি তিনি তোর বেদনা বুঝতে পারেন তবেই, তা না হলে যতো বড়োই মনস্তত্ত্ববিদ হন, এরকম শক্ত জায়গায় তাঁরা ভয়ানকভাবে ঠকবেন! একটি প্রস্ফুটিত ফুলের হাসিতে যে কত কান্নাই লুকানো থাকে, তা কে বুঝবে? ফুলের ওই শুভ্র বুকে যে ব্যথার কীটে কত দাগ কেটেছে, কে তা জানতে চায়?—আমরা উপভোগ করতে চাই ফুলের ওই হাসিটি, ওই উপরের সুরভিটুকু!
সত্য বলতে গেলে, আমি যতই বড়াই করি ভাই, কিন্তু তোকে বুঝে উঠতে পারলাম না। যখনই মনে করেছি, এই তোর মনের নাগাল পেয়েছি, অমনি তোর গতি এমন উলটো দিকে ফিরে যায় যে, আমি নিজের বোকামিতে নিজেই না হেসে থাকতে পারিনে। এই তোর যুদ্ধে যাবার আগের ঘটনাটাই ভেবে দেখ না!—আমার যেন একদিন মনে হল যে, সোফিয়ার সই মাহ্বুবাকে দেখে তুই মুগ্ধ হয়েছিস। তাই বড়ো আনন্দে সেদিন গেয়েছিলাম, ‘এবার সখী সোনার মৃগ দেয় বুঝি ধরা!’ এবং আমার মোটা বুদ্ধিতে সব বুঝেছি মনে করে তার সঙ্গে তোর বিয়ের সব ঠিক-ঠাক করলাম, এমন সময় হঠাৎ একদিন তুই যুদ্ধে চলে গেলি। আমার ভুল ভাঙল, অনেকের বুক ভাঙল! সোনার শিকল দেখে পাখি মুগ্ধ হয়ে যেন কাছিয়ে এসেছিল, কিন্তু যেই জানলে ওতে বাঁধনের ভয় আছে, অমনি সে সীমাহীন আকাশে উড়ে গেল।
এইখানে আর একটা কথা বলি, কিন্তু তুই মনে করিস না যেন যে আমি নিজের সাফাই গাইছি। প্রথমে সত্য সত্যই তোর এ বিয়েতে আমার উৎসাহ ছিল না, যদিও কেউ ক্ষুণ্ণ হবে বলে আমি এ কথাটা কাউকে তেমন জানাইনি। তার প্রধান কারণ, তুই কোথাও কোনো ধরা-ছোঁওয়া দিসনি। আবার যেখানে ইচ্ছা করে ধরা দিতে গিয়েছিস, সেইখানেই কার নিষ্ঠুর হাত এসে তোকে আলাদা করে দিয়েছে, মুক্ত করে দিয়েছে! সে-কোন্ চপল যেন তোর খেলার সাথি! সে-কোন্ চঞ্চলের যেন তুই ছাড়া-হরিণ! তাই কোনো বাঁধন তোকে বাঁধতে পারে না। কিন্তু এ সব জেনেও এমন কিছু ঘটল, যাতে আমারও মনটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল।…আমার মস্ত বিশ্বাস ছিল যে, পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই মানুষের মন বুঝতে বেশি ওস্তাদ! কিন্তু এখন দেখছি, সব ভুয়ো। কারণ তোর মাননীয়া ভাবিসাহেবাই আমায় কান-ভাঙানি দিয়েছিলেন এবং সাফ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তুই নাকি মাহ্বুবাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলি, এমনকি তুই নাকি আর তোর মধ্যে ছিলি নে এবং মাহ্বুবাও নাকি তোর পায়ে একেবারে মনঃপ্রাণ ‘ডারি’ দিয়েছিল। এমন দু-তরফা ভালোবাসাকে মাঝ-মাঠে শুকোতে দেওয়া আমাদের মতো নব্যশিক্ষিতদের পক্ষে একরকম পাপ কিনা, তাই বড়ো খুশি হয়েই তোদের এ বুকের ভালোবাসাকে সোনার সুতোয় গেঁথে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কাজের বেলায় হয়ে গেল যখন সব উলটো, তখন যত দোষ এই নন্দ ঘোষের ঘাড়েই হুড়মুড় করে পড়ল! অবশ্য আমার একটু সব দিক ভেবে কাজ করা উচিত ছিল, কিন্তু যুবতিদের—আবার তিনি যদি ভার্যা হন, তবে তো কথাই নেই—এমন একটা মোহিনী শক্তি আছে, যাহা মহা জাহাঁবাজ পুরুষেরও মন একেবারে গলে মোম হয়ে যায়! তখনকার মতো বেচারার আর আপত্তি করবার মতো কোনো শক্তিই থাকে না। সাধে কী আর জ্ঞানীরা বলেছেন যে, মেয়েরা আগুন, আর পুরুষ সব মোম,—কাছাকাছি হয়েছে কী গলেছে। আমি আমার ধৈর্যশীলতার জন্যে চির-প্রসিদ্ধ কি-না, তাই এখন যত মিথ্যা অপরাধের বোঝাগুলোও নির্বিকার চিত্তে বইতে হচ্ছে। এক কথায়,—ওই যে কী বলে,—আমি হচ্ছি ‘সাহেবের দাগা পাঁঠা!’
তারপর, আমি এখন ভাবচি যে, যে-যুদ্ধের মানুষ কাটাকাটির বিরুদ্ধে’বক্তিমের’ তোড়ে তুই সুরেনবাবুর রুটি মারবার জোগাড় করেছিলি, মাঝে আবার জীবহত্যা মহাপাপ বলে স্রেফ শাকান্নভোজী নিরামিষ-প্রাণী বা পরমহংস হয়ে পড়েছিলি, সেই তুই জানি নে কোন্ অনুপ্রেরণায় এই ভীম নরহত্যার যজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়লি! জানি নে, সে কোন্ বজ্রবাঁশি তোকে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল, তোর এই বাঁধন হারা প্রাণটিকে জননী জন্মভূমির পায়ে ফুলের মতো উৎসর্গ করে দিতে! তবে কি এটা তোর সেই বিপরীত স্বভাবটা, যেটা অন্যায়ের খোঁচা না খেলে জেগে উঠত না? অন্যায়কে রুখতে গিয়ে এক একদিন তুই যেরকম খুনোখুনি ব্যাপার বাধিয়ে তুলতিস, তা তো আর কারুর অবিদিত নেই! আমি এখনও ভাবি, সে সময় কীরকম প্রদীপ্ত হয়ে উঠত একটা অমানুষিক শক্তিতে তোর ওই অসুরের মতো শক্ত শরীরটা। আসানসোলে ম্যাচ খেলতে গিয়ে যেদিন একা এক প্রচণ্ড বংশদণ্ড দিয়ে প্রায় এক শত ইংরেজকে খেদিয়ে নিয়ে গিয়েছিলি, সেই দিন বুঝেছিলাম তোর ওই কোমল প্রাণের আড়ালে কত বড়ো একটা আগ্নেয় পর্বত লুকিয়ে আছে, যেটা নিতান্ত উত্তেজিত না হলে অগ্ন্যুদ্গিরণ করে না।
বড়ো কৌতূহল হয়, আর জানাও দরকার, তাই তোর সমস্ত কথা জানতে চেয়েছিলাম। তাতে যদি তোর কোনো পবিত্র স্মৃতির অবমাননা হয় মনে করিস, তবে আমি তা জানতে চাই নে। আমি সেরকম নরাধম নই। কিন্তু এ কোন্ ভাগ্যবতী রে যে তোর এমন হাওয়ার প্রাণেও রেখা কেটে দিয়েছে? সে কোন্ সুন্দরীর বীণের বেদন তোর মতো চপল হরিণকে মুগ্ধ করেছে? কেন তুই তবে এসব কথা কাউকে জানাসনি? তুই সত্য সত্যই একটা মস্ত প্রহেলিকা!
সোফিয়ার বিয়ে নিয়ে তোকে আর মাথা ঘামাতে হবে না। তুই নিজের চরকায় তেল দে। তোর মতো বিবাহ-বিদ্বেষী লোকের আবার পরের বিয়ের এত ভাবনা কেন? আমরা মনে করেছি, আর তোর ভাবিরও নিতান্ত ইচ্ছা যে, মনুয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিই। তোর কী মত? তবে আরও দু-চার মাস দেরি করতে হবে। কেননা মনুর বি. এ. পরীক্ষা দেবার সময় খুব নিকট। ওর পরীক্ষার ফল বেরিয়ে গেলেই শুভকার্যটা শেষ করে ফেলব মনে করচি। তুই সেই সময় ছুটি নিয়ে বাড়ি আসতে পারবি নাকি? তুই না এলে যে ঘরের সবকিছু কাঁদবে!
তোর সামনে সোফিয়া তোর খুব বদনাম করত আর তোর সঙ্গে কথায় কথায় ঝগড়া করত বটে, কিন্তু তুই যাবার পর হতেই তার মত আশ্চর্য রকমে বদলে গিয়েছে। সে এখন তোর এত বেশি প্রশংসা করতে আরম্ভ করেছে যে, আমি হিংসে না করে থাকতে পারচি নে। তোর এই যুদ্ধে যাওয়াটাকে সে একটা মস্ত কাজের মতো কাজ বলে ডঙ্কা পিটুচ্চে। তুই চলে যাবার পর ওর যদি কান্না দেখতিস! সাত দিন সাত রাত না খেয়ে না দেয়ে সে শুধু কেঁদেছিল। এখনও তোর কথা উঠলেই তার চোক ছলছল করে ওঠে।… সে তার হাতের বোনা কয়েকটা ‘কম্ফর্টার’ আর ফুল তোলা রুমাল পাঠিয়েছে তোকে, বোধ হয় পেয়েছিস। তোকে তোদের এই যুদ্ধের পোশাকে দেখবার জন্যে সে বড্ড সাধ করেছে। এখনকার ফটো থাকে তো পাঠাস। যখন যা টাকাকড়ির দরকার হবে জানাস। এখন আর কোনো কষ্ট হয় না তো? এখানে সব একরকম ভালো।
উপসংহারে বক্তব্য এই যে, তুই আমায় নবনীতকোমল মাংসপিণ্ড-সমষ্টি বলে ঠাট্টা করেছিস, কিন্তু এখন এলে দেখতে পাবি, এই দু-বছরেই সংসার আর বিবি-সাহেবার চাপে আমি সজনে কাঠের চেয়েও নীরস হয়ে পড়েছি । তোর উপরটা লোহার মতো শক্ত হলেও ভিতরটা ফুলের চেয়েই নরম! তুই বাস্তবিকও শুক্তি, উপরটা ঝিনুকের শক্ত খোসায় ঢাকা আর ভিতরে মানিক। আর আমি হচ্চি ওই—সজনে কাঠের শুকনো ঠ্যাঙা,—না উপরটা মোলায়েম, না ভিতরে আছে কিছু রস-কষ। একেবারে ভুয়ো—ভুয়ো! ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষী
হাড়গোড়-ভাঙা ‘দ’
রবিয়ল
বাবা নূরু!
সূত্র : নজরুল রচনাবলী
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা...
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৫১-১৫৭
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪৬-১৫০
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪১-১৪৫