Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৪

নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দ্বিতীয় দৃশ্য
গুরুধাম
শিষ্যশিষ্যাপরিবৃত গুরু। জটাজাল বিলম্বিত পিঠের উপরে। গেরুয়া চাদরখানা স্থূল উদরের উপর দিয়ে বেঁকে পড়েছে, ঘোলা জলের ঝরনার মতো। ধূপধূনা। গদির এক পাশে খড়ম, যারা আসছে খড়মকে প্রণাম করছে, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলছে— গুরো। গুরুর চক্ষু মুদ্রিত, বুকের কাছে দুই হাত জোড়া। মেয়েরা থেকে থেকে আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে। দুজন দু পাশে দাঁড়িয়ে পাখা করছে। অনেকক্ষণ সব নিস্তব্ধ।
গুরু। (হঠাৎ চোখ খুলে) এই-যে, তোমরা সবাই এসেছ, জানতেই পারি নি। সিদ্ধিরস্তু সিদ্ধিরস্তু। এখন মন দিয়ে শোনো আমার কথা।
সেবক। মন তো প’ড়েই আছে গুরুর চরণে।
শিষ্যাদের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না
গুরু। আজ তোমাদের বড়ো কঠিন পরীক্ষা। মুক্তির সাতটা দরজার মধ্যে এইটে হল তিনের দরজা। শিবোহং শিবোহং শিবোহং। এইটে কোনোমতে পেরলে হয়। যাদের ধনের থলি ফেঁপে উঠেছে উদুরি-রুগির পেটের মতো, তারা এই সরু দরজায় যায় আটকে, জাঁতাকলের মতো।
সকলে। হায় হায় হায়, হায় হায় হায়!
গুরু। এইখেনে এসে মুক্তির ইচ্ছেতেই ঘটে বাধা। কেউ বসে পড়ে, কেউ ফিরে যায়। তার পরে এক দুই তিন, ঘণ্টা পড়ল, বাস্— হয়ে গেল, ডুবল নৌকো, আর টিকি দেখবার জো থাকে না। ক্রিং হ্রিং ক্রম্।
সকলে। হায় হায় হায়, হায় হায় হায়!
গুরু। এতকাল আমার সংসর্গে থেকে তোমাদের ধনের লোভ কিছু হাল্কা হয়েছে যদি দেখি, তা হলে আর মার নেই। এইবার তবে শুরু হোক। ওহে চরণদাস, গানটা ধরো।
গুরুপদে মন করো অর্পণ,
ঢালো ধন তাঁর ঝুলিতে—
লঘু হবে ভার, রবে নাকো আর
ভবের দোলায় দুলিতে।
হিসাবের খাতা নাড় ব’সে ব’সে,
মহাজনে নেয় সুদ কষে কষে—
খাঁটি যেই জন সেই মহাজনে
কেন থাক হায় ভুলিতে,
দিন চলে যায় ট্যাঁকে টাকা হায়
কেবলি খুলিতে তুলিতে।
গুরু। কী নিতাই, চুপ করে বসে বসে মাথা চুলকোচ্ছ যে? মন খারাপ হয়ে গেছে বুঝি! আচ্ছা, এই নে, পায়ের ধুলো নে।
নিতাই। তা, গুরুর কাছে মিথ্যে কথা বলব না। খুবই ভাবনা আছে মনে। কাল সারারাত ধস্তাধস্তি করে স্ত্রীর বাক্স ভেঙে বাজুবন্দজোড়া এনেছি।
গুরু। এনেছ, তবে আর ভাবনা কী।
নিতাই। প্রভো, ভাবনা তো এখন থেকেই। বউ বলেছে, ঘরে যদি ফিরি তবে ঝাঁটাপেটা করে দূর করে দেবে।
গুরু। সেজন্যে এত ভয় কেন।
নিতাই। এ মারটা প্রভুর জানা নেই, তাই বলছেন।
গুরু। নারদসংহিতায় বলে, দাম্পত্যকলহে চৈব— ঝগড়া দুদিনে যাবে মিটে।
নিতাই। ঐ নারীটিকে চেনেন না। সীতা সাবিত্রীর সঙ্গে মেলে না। নাম দিয়েছি হিড়িম্বা। তা, বরঞ্চ যদি অনুমতি পাই তা হলে দ্বিতীয় সংসার করে শান্তিপুরে বাসা বাঁধব।
গুরু। দোষ কী! বশিষ্ঠ প্রভৃতি ঋষিরা বলেছেন, অধিকন্তু ন দোষায়। সেইরকম দৃষ্টান্তও দেখিয়েছেন। পুরুষের পক্ষে স্ত্রী গৌরবে বহুবচন।
মাধব। তার মানে একাই এক সহস্র।
গুরু। উল্টো। আধ্যাত্মিক অর্থে পুরুষের পক্ষে এক সহস্রই একা। বড়ো বড়ো সজ্জন কুলীন বহু কষ্টে তার প্রমাণ দিয়েছেন। সেই জন্যেই এ দেশকে বলে পুণ্যভূমি— পূণ্যবিবাহকর্মে আমাদের পুরুষদের ক্লান্তি নেই।
মাধব। আহা, এ দেশের আধ্যাত্মিক বিবাহের এমন সুন্দর ব্যাখ্যা আর কখনও শুনি নি।
গুরু। কী গো বিপিন, প্রস্তুত তো? যেমন বলেছিলুম, কাল তো সারারাত জপ করেছিলে— সোনা মিথ্যে, সোনা মিথ্যে, সব ছাই,সব ছাই?
মাধব। জপেছি। মোহরটা আরো যেন তারার মতো জ্বল জ্বল করতে লাগল মনের মধ্যে। (গুরুর পা জড়িয়ে ধরে) প্রভু, আমি পাপিষ্ঠ, এবারকার মতো মাপ করো, আরো কিছুদিন সময় দাও।
গুরু। এই রে! মোলো, মোলো দেখছি। সর্বনাশ হল। দিতে এসে ফিরিয়ে নেওয়া, এ যে গুরুর ধন চুরি করা! (ঝুলি এগিয়ে দিয়ে) ফেল্ ফেল্ বল্ছি, এখ্খনি ফেল্।
মাধব বহু কষ্টে কম্পিত হস্তে রুমাল থেকে মোহর খুলে নিয়ে ঝুলিতে ফেলল
এইবার সবাই মিলে বলো দেখি—
সোনা ছাই, সোনা ছাই, সোনা ছাই।
নাহি চাই, নাহি চাই, নাহি চাই।
নয়ন মুদিলে পরে কিছু নাই, কিছু নাই, কিছু নাই।
সকলের চীৎকারস্বরে আবৃত্তি
এই-যে, মা তারিণী! এস এস, এই নাও আশীর্বাদ। তোমার ভাবনা নেই, তুমি অনেক দূরে এগিয়েছ। তোমরা মেয়েমানুষ, তোমাদের সরল ভক্তি, দেখে পুরুষদের শিক্ষা হোক।
তারিণী পায়ের কাছে এক জোড়া বালা রেখে অনেকক্ষণ মাথা ঠেকিয়ে রাখল
(গুরু হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে) গুরুভার বটে— বন্ধনটা বেশ একটু চাপ দিয়েছিল মনটাকে। যাকগে, এত দিনে হাতের বেড়ি তোমার খসল। লোহার বেড়ির চেয়ে অনেক কঠিন— ঠিক কিনা, মা?
তারিনী। খুব ঠিক, বাবা। মনে হচ্ছে, খানিকটা মাংস কেটে নিলে।
গুরু। মাংস নয়, মাংস নয়, মোহপাশ। গ্রন্থি এই সবে আল্গা হতে শুরু করল, তার পরে ক্রমে ক্রমে—
তারিণী। না বাবা, আর পারব না। মেয়ের বিয়ের জন্যে শাশুড়ির আমলের গয়নাগুলি যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
গুরু। (থলির মধ্যে বালাজোড়া ফেলে দিয়ে) আচ্ছা আচ্ছা, এখনকার মতো এই পর্যন্তই থাক্। তোমরা বলো সবাই— সোনা ছাই ইত্যাদি।

সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।