Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৭

নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুষ্প। লোকটার পরিচয় নিতে হবে তো।
মাখন। নিশ্চয় নিশ্চয়। হাসতে হাসতে পেট ফেটে যাবে, আমার চেয়ে মজা।
পুষ্প। ভালো হল। হনুমানের সঙ্গে অঙ্গদ চাই। ওকে তোমারই হাতে তৈরি করে নিতে হবে। শেওড়াফুলির হাট উজাড় করে কলার কাঁদি আনিয়ে নেব।
মাখন। শুধু কলার কাঁদির কর্ম নয়।
পুষ্প। তা নয় বটে। যে কারখানায় তুমি নিজে তৈরি সেখানকার দুই-চাকাওয়ালা যন্ত্রের তলায় ওকে ফেলা চাই।
মাখন। দয়াময়ী, জীবের প্রতি এত হিংসা ভালো নয়।
পুষ্প। ভয় নেই, আমি আছি, হঠাৎ অপঘাত ঘটতে দেব না। আপাতত কলার ছড়াটা ওকে দিয়ে এসো।
মাখন। আমাদের দেশে মেয়েরা থাকতে সন্ন্যাসী না খেয়ে মরে না। কিন্তু, ও লোকটা ভুল করেছে—বৈরাগির ব্যাবসা ওর নয়, ওর চেহারায় জলুষ নেই। নিতান্ত নিজের স্ত্রী ছাড়া ওর খবরদারি করবার মানুষ মিলবে না।
পুষ্প। তোমার অমন চেহারা নিয়ে তুমি ছ বছর চালালে কী করে।
মাখন। ময়রার দোকানে মাছি তাড়িয়েছি, পেয়েছি বাসি লুচি তেলে-ভাজা, যার খদ্দের জোটে না। যাত্রার দলে ভিস্তি সেজেছি, জল খেতে দিয়েছেন অধিকারী মুড়কি আর পচা কলা। সুবিধে পেলেই মা মাসি পাতিয়ে মেয়েদের পাঁচালি শুনিয়ে দিয়েছি
যখন পুরুষরা কাজে চলে গেছে—
ওরে ভাই, জানকীরে দিয়ে এস বন—
ওরে রে লক্ষ্মণ, এ কী কুলক্ষণ, বিপদ ঘটেছে বিলক্ষণ।
মা-জননীদের দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রুধারা ঝরেছে— দু-চার দিনের সঞ্চয় নিয়ে এসেছি। আমাকে ভালোবাসে সবাই। জ্যাঠাইমা আমার যদি দুটো বিয়ে না দিত তা হলে চাই কি আমার নিজের স্ত্রীও হয়তো আমাকে ভালোবাসতে পারত। বাইরে থেকে বুঝতে পারবে না,কিন্তু আমারও কেমন অল্পেতেই মন গলে যায়। এই দেখো-না, এখন তোমাকে মা-অঞ্জনা বলতে ইচ্ছে করছে।
পুষ্প। সেই ভালো, আমার নাতির সংখ্যা বেড়ে চলেছে, দিদির পদটা বড্ড বেশি ভারি হয়ে উঠল। আচ্ছা, জিগেস করি, তোমার মনটা কী বলছে।
মাখন। তবে মা, কথাটা খুলে বলি। অনেক দিন পরে এ পাড়ার কাছাকাছি আসতেই প্রথম দিনই আমার বিপদ বাধল ফোড়নের গন্ধে। সেদিন আমাদের রান্নাঘরে পাঁঠা চড়েছিল— সত্যি বলি, বড়ো বোয়ের মুখ খারাপ, কিন্তু রান্নায় ওর হাত ভালো। সেদিন বাতাস শুঁকে শুঁকে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি সারাদিন। তার পর থেকে অর্ধভোজনের টানে এ পাড়া ছাড়া আমার অসাধ্য হল। বারবার মনে পড়ছে, কত দিনের কত গালমন্দ আর কত কাঁটাচচ্চড়ি। একদিন দিব্যি গেলেছিলুম, এ বাড়িতে কোনোদিন আর ঢুকব না। প্রতিজ্ঞা ভেঙেছি কাল।
পুষ্প। কিসে ভাঙালো।
মাখন। তালের বড়ার গন্ধে। দিনটা ছট্ফট্ করে কাটালুম। রাত্তিরে যখন সব নিশুতি, বাইরে থেকে ছিট্কিনি খুলে ঢুকলুম ঘরে। খুট করে শব্দ হতেই আমার ছোটোটি এক হাতে পিদিম এক হাতে লাঠি নিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে। মুখে মেখে এসেছিলুম কালি, আমি হাঁ করে দাঁত খিঁচিয়ে হাঁউমাউখাঁউ করে উঠতেই পতন ও মূর্ছা। বড়ো বউ একবার উঁকি মেরেই দিল দৌড়। আমি রয়ে বসে পেট ভরে আহার করে ধামাসুদ্ধ বড়া নিয়ে এলুম বেরিয়ে।
পুষ্প। কিছু প্রসাদ রেখে এলে না পতিব্রতাদের জন্যে?
মাখন। অনেকখানি পায়ের ধুলো রেখে এসেছি, আর বড়াগুলো নিয়ে এসেছি দলবলকে খাইয়ে দিতে।
পুষ্প। আচ্ছা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, সত্যি বলবে?
মাখন। দেখো মা, বিপদে না পড়লে আমি কখনো মিথ্যে কথা কই নে।
পুষ্প। লোকে বলে, তুমি কাশীতে গিয়ে আরও একটা বিয়ে করেছ।
মাখন। তা করেছি।
পুষ্প। পিঠ সুড়্সুড়্ করছিল?
মাখন। না মা, দুটো বিয়ে কাকে বলে হাড়ে হাড়ে জেনেছি। ভারি ইচ্ছা হল, একটা বিয়ে কি রকম মরার আগে জেনে নেব।
পুষ্প। জেনে নিয়েছ সেটা?
মাখন। বেশি দিন নয়। ভাগ্যবতী কিনা, পুণ্যফলে মারা গেল সকাল-সকাল, স্বামী বর্তমানেই। ঘোমটা সবে খুলেছে মাত্র। কিন্তু ভালো ক’রে মুখ ফোটবার তখনো সময় হয়নি। বেঁচে থাকলে কপালে কী ছিল বলা যায় না।
পুষ্প। কার কপালে?
মাখন। শক্ত কথা।

সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।