Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Shorge cokrotable boytok - Rabindranath Tagore

Shorge cokrotable boytok - Rabindranath Tagore

স্বর্গে চক্রটেবিল বৈঠক : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ব্রক্ষ্মা। পুরন্দর, তোমাদের অত্যন্ত কৃশ দেখাচ্ছে, যেন অনাবৃষ্টিদিনের পাতা-ঝরা বনস্পতির মতো। স্বর্গে কি অমৃত-সঞ্চয়ে দৈন্য ঘটেছে?

ইন্দ্র। পিতামহ, অনাবৃষ্টিই তো বটে। স্বর্গীয় বনস্পতির শিকড় আছে মর্ত্যের মাটিতে—দিনে দিনে সেখানে শ্রদ্ধার রস শুকিয়ে এসেছে। নরলোকে কানাকানি চলছে, যে সৃষ্টিব্যাপারটা আকস্মিক মহামারীর মতো, বসন্তের গুটি যেন, আপনা হতেই আপনাকে হঠাৎ ফুটিয়ে তোলে; এটা দেবতার হাতের কারুকার্য নয়। অর্থাৎ এটা এমন একটা রোগ, যা চলছে মৃত্যুর অনিবার্য পরিণামে। এমন-কি, ওখানকার পন্ডিতরা চরম চিতানলের দিনক্ষণ পর্যন্ত অঙ্ক কষে স্থির করে দিয়েছে।

ব্রক্ষ্মা। সর্বনাশ। এ যে অনাদিকালের ভূতভাবনের বেকার-সমস্যা।

ইন্দ্র। তাই তো বটে। ওরা বলছে, দেবতারা কোনোদিন কোনো কাজই করে নি অতএব ওদের মজুরি বন্ধ।

ব্রক্ষ্মা। বলো কী, হোমানলের ঘৃতটুকুও মিলবে না?

ইন্দ্র। না পিতামহ। সেটা ভালোই হয়েছে—যে ঘৃতের এখন চলতি সেটাতে অগ্নিদেবের অগ্নিমান্দ্য হবার আশঙ্কা।

বৃহস্পতি। আদিদেব, এতদিন ছিলুম মানুষের অসংশয় বিশ্বাসে—অত্যন্তই নিশ্চিন্ত ছিলুম। এখন পন্ডিতের দল মনোবিজ্ঞানের এক্কাগাড়িতে চাপিয়ে মানুষের মাথার খুলির একটা অকিঞ্চিৎকর কোটরে আমাদের ঠেলে দিয়েছে; সেখানে মগজের গন্ধ আছে, অমৃতের স্বাদ নেই; বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার বেড়ার মধ্যে আমাদের ঘের দিয়ে দিয়ে রেখেছে—যাকে ম্লেচ্ছভাষায় বলে কন্‌সেন্‌ট্রেশন্ ক্যাম্প—কড়া পাহারা! অবতারের যে পুরতত্ত্ব বের করেছে, তাতে নৃসিংহের কোনো চিহ্ন নেই, আছে নৃবানরের মাথার খুলি।

মরুৎ। আমার পুত্র মারুতিকে ওরা অগ্রজ ব’লে স্বীকার করেছে এতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু লজ্জার বিষয় এই যে, দেবতারা ভুক্ত হয়েছে অ্যান্থপলজি নামক অর্বাচীন ম্লেচ্ছশাস্ত্রের বাল্যলীলা পর্বে। দেব, আশা দিয়েছিলে আমরা অমর, আজ দেখছি ওদের পরীক্ষাগারে ব্যাঙের একটা কাটা পাও ইন্দ্রপদের চেয়ে বেশি সজীব। সেদিন সুরবালকেরা সুরগুরুকে ধরে পড়েছিল, ‘প্রমাণ ক’রে দিন আমরা আছি’। গুরুর সন্দেহে দোলা লাগল—আছি কি নেই এই তালে তাঁর মাথা নড়তে লাগল, মুখ দিয়ে কথা বেরল না। পিতামহ যদি সন্দেহ ভঞ্জন ক’রে দেন তা হলে দেবলোক সুস্থ হতে পারে।

ব্রক্ষ্মা। পিতামহের চার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। মনে ভাবছি মরলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের আচার্য হয়ে যদি জন্মাতে পারি তা হলে অন্তত কোনো এক চৌমাথার ট্রাম লাইনের ধারে একটা পাথরের মূর্তি দাবি করিতে পারব। আজ আমার মূর্তির ভাঙা টুকরো নিয়ে প্রফেসর তারিখ হিসাব করছে অথচ এতদিন এই বিশ্বাস দৃঢ় ছিল যে আমি সকল তারিখের অতীত।

প্রজাপতি। ভগবান্, সকলেই জানেন ধরাধামে আমি আর কন্দর্পদেব অবতীর্ণ হয়েছিলুম শুভ এবং অশুভ বিবাহের ঘটকালিতে। সেজন্যে আমাদের কোনো রকমের নিয়মিত বা অনিয়মিত পাওনা ছিলনা, কেবল নিমন্ত্রণপত্রের মাথার উপরে ছাপার অক্ষরে আমার উদ্দেশে একটা নমস্কার স্বীকৃত ছিল। কিন্তু কৌতুক ছিল ভূরি-পরিমাণে। বাসর-ঘরে অনেকে কানমলা দেখেছি পরিহাস-রসিকাদের হাতে, আর দেখেছি অদৃশ্য পরিহাস-রসিকের হাতে চিরজীবনের কান-মলা। আমি প্রজাপতি আজ লজ্জিত, কন্দর্প আজ নির্জীব—তিনি পঞ্চাশর নিয়ে যখন আস্ফালন করিতে যান তখন তীরগুলো ঠিকরে যায় কোম্পানির কাগজ-নির্মিত বর্মের ‘পরে।

অতএব উক্ত বিভাগের সনাতনী খাতা থেকে আমাদের নাম কেটে নিয়ে টঙ্কেশ্বরী দেবীর নাম বহাল হোক।

সকলে। তথাস্তু।

বায়ু। পৃথিবীতে আজকাল পাগলা হাওয়া পলিটিক্সের ঈশান কোণ থেকে সৃষ্টি ছারখার করতে প্রবৃত্ত। আমি আজ চন্দ্রলোকে সমস্ত বিরহিণীদের দীর্ঘনিশ্বাস বহন ক’রে ফিরে যেতে ইচ্ছা করি।

অশ্বিনীকুমার। সুবিধা হবে না দেব। মর্ত্যের পন্ডিতেরা ঘোষনা করে দিয়েছেন যে, চন্দ্র বায়ুর প্রকোপ বৃদ্ধি করেন বটে, কিন্তু স্বয়ং তিনি বায়ুহারা।

বায়ু। নাহয় সেখানে গিয়ে আত্মহত্যা করব।

ভোলেনাথ। (অর্ধনিমীলিত নেত্রে) আমার চেয়ে গাঁজার মৌতাত অনেক প্রবল, পৃথিবীতে এমন সর্বনেশে ওস্তাদের অভাব নেই—সেই-সব সংস্কারকদের উপর প্রলয়কাের্যের ভার দিয়ে আমি গঙ্গাধারাভিষেকে মাথা ঠান্ডা করতে পারি। আমার ভূতগুলোর ভার তাঁরাই নিতে পারবেন।

চিত্রগুপ্ত। মনঃক্ষোভে দেবগনের অভিযোগে অত্যুক্তি প্রকাশ পেয়েছে। যথাযথ তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজন বোধ করি। সুরগুরু কোনোদিন সংখ্যাতত্ত্বের আলোচনা করেন নি। সেইজন্যে দেবতাদের গণিত স্বেচ্ছাগণিত। মর্ত্যে দেবগণের অধিকারে কী পরিমাণে খর্বতা ঘটেছে তার নির্ভুল সীমা নির্ণয়ের জন্য স্বপ্নাদেশ দেওয়া হোক কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংখ্যিক প্রমাণ-বিশারদের মাথায়; এ কাজে বৈজ্ঞানিক প্রশান্তি অত্যাবশ্যক।

বায়ু। এ প্রস্তাবের সমর্থন করি। দেবতাদের হতাশ হবার কারণ নেই। মানুষের বুদ্ধিতে অকস্মাৎ হাওয়াবদল বার বারই দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষত দুর্দিনে। দেউলে হবার দিনে মাতনের খরচ বেড়ে ওঠে। মানুষের বুদ্ধিতে সব সময় জোয়ার আসে না—একদা তলার পাঁক বেরিয়ে পড়ে। তখন পান্ডার পদপঙ্কের দাম চড়ে যায়, দেবতারাও তার অংশ পান।

বৃহস্পতি। আশ্বস্ত হলুম। (সরস্বতীর প্রতি) মুখ ম্লান করিবেন না, দেবী, মানুষের আত্মবুদ্ধির উপর শ্রদ্ধা কমবার সঙ্গে সঙ্গেই দেবীর ভোগের বরাদ্দ বাড়তে থাকে। বুদ্ধিতে ভাঁটার টান প্রবল, ভূমন্ডলে এমন দেশ আছে। শীতলা ঠাকরুনও সেই ভরসাতেই মন্দির-ত্যাগের আশঙ্কা ছেড়ে দিয়েছেন।

-o-

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।