আঁধার বদলায়
সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায়
চাঁদমারির মাঠে, ঝড়ো গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিল ওরা। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। পেছনে খ্রিস্টানদের পরিত্যক্ত কবরস্থান। গাছ গাছালিতে ভর্তি। তার পেছনে নিষিদ্ধ পল্লী। সামনে স্টেশন, শহর থেকে দূরে। ট্রেনের কমতির সঙ্গে প্যাসেনজারের কার্পণ্যতা—বড় দৃষ্টিকটু।
ওরা দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি।
ছেলেটির চোখে জ্বলন্ত দৃষ্টি। মেয়েটির মুখ ভার।
কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গ পথের মতো মেয়েটির কোমর থেকে, শালোয়ার কামিজ পড়ল পায়ের কাছে টুপ করে।
ছেলেটি আবেগে জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। বুকের মাঝে। অন্ধকার ফুঁড়ে শব্দ বের হয় মেয়েটির গলা থেকে—‘তুমি যে কালীবাড়ি নিয়ে যাবে, মন্দিরে সিন্দুর দান করবে বলেছিলে?’
ছেলেটির হাত মুখ ঘুরছে যত্রতত্র। জবাবে গো গো শব্দ উঠল।
মেয়েটি অভিযোগ ছোঁড়ে—‘কিছুদিন ধরেই কথা রাখছ না? বল কবে কালীবাড়ি যাবে?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ হবে, হবে’ করে মেয়েটির মুখে নিজের মুখ চেপে ধরে বন্ধ করে দেয় মেয়েটির মুখ।
ঝিল্লিমুখর শহর নীরব হয়ে আসে। পাশেই স্টেশন, মালগাড়ি পার হচ্ছে, ঘটাং-ঘট শব্দ উঠছে। শব্দটা সুবিধে করে দিচ্ছে ওদের। ছেলেটি চেটেপুটে কাঁচা মাংস ভক্ষণ করছে।
ট্রানজিস্টার বাজছে দূরে।
হাতের চেটোতে খৈনি থাবড়াতে থাবড়াতে পেটমোটা কনস্টেবল। ‘রামা হো, রামা হো’ গাইতে গাইতে কর্তব্যকর্ম পালন করার জন্যেই—ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
—‘কোন হ্যায় রে?’
পুলিশ দেখে, ছেলেটা দৌড় মারে। মেয়েটা ধরা পড়ে।
মেয়েটি এদের চেনে। মেয়েটি পথের ধারে ঝুপড়িতে মানুষ। রুলের গুঁতো মেরে মাকে তুলে
নিয়ে যেতে দেখেছে। নরম প্রাণে প্রথম প্রথম সরম জেগেছে ঢের।
খৈনি মুখে পুরে খপ্ করে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে। মেয়েটি ভাবে—দুনিয়ার সব পুরুষের চাহিদা কি এক! স্বভাবেও কি তারতম্য থাকতে নেই!
আকাশে ক্ষীণ চাঁদ। হাওয়া উঠেছে গাছের মাথায়। সারাদিনের দগ্ধীভূত ধরিত্রী শীতল হচ্ছে।
কুকর্ম না-করার আদেশ জারি করে, পুলিশটা ফুড়ুৎ হতেই আর একটা লোক কাছে আসে।
অনেকক্ষণ ধরেই কাশছিল। টর্চের আলো ফেলে, মেয়েটির দেহে। মেয়েটি সালোয়ার
কামিজ গায়ে তোলে। প্রেমিক গা ঢাকা দিয়েছিল, কাছেই, পুলিশ চলে যেতেই, সামনে এসে গজগজ করে—‘শালা, পুলিশের জ্বালায় কি কোথাও শান্তি আছে?’
টর্চের আলোয় এখন সব আলোকিত, প্রেমিকের বুকের গহ্বরটা পর্যন্ত। মেয়েটি কয়েকদিনেই বুঝে নিয়েছে—জীবনে, এখানে কোন পৃথক মূল্য নেই। টর্চ-ধারি লোকটা, বেশ লম্বা। একটা বিশটাকার নোট বাড়িয়ে দেয়।
প্রেমিক খ্যাক খ্যাক করে ওঠে—‘এ সব কি হচ্ছে?’
মেয়েটির গায়ে হাত রেখে বলে—‘এ আমার।’
মেয়েটি, হাতটা ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে ছৌমেরে নোটটা তুলে নেয়, লম্বা লোকটার কোমরে জড়িয়ে ধরে—সামনে পা বাড়ায়।
এদের জীবনে আঁধার কাটে না। আঁধার শুধু রূপ বদলায়!
…………………
পড়ুন
কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের একগুচ্ছ কবিতা
সুনীল শর্মাচার্যের ক্ষুধাগুচ্ছ
লকডাউনগুচ্ছ : সুনীল শর্মাচার্য
গল্প
এক সমাজবিরোধী ও টেলিফোনের গল্প: সুনীল শর্মাচার্য
আঁধার বদলায় : সুনীল শর্মাচার্য
প্রবন্ধ
কবির ভাষা, কবিতার ভাষা : সুনীল শর্মাচার্য
মুক্তগদ্য
খুচরো কথা চারপাশে : সুনীল শর্মাচার্য
‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ পাঠ্যান্তে
ভারতের কৃষিবিল যেন আলাদিনের চেরাগ-এ-জিন
বাঙালিদের বাংলা চর্চা : খণ্ড ভারতে
৫৭ thoughts on “আঁধার বদলায়”