The path of love : Osho Rajneesh
প্রেমের সরল পথ (দি পাথ অব লাভ) : ওশো রজনীশ
অনুবাদ : শুভ্র চৌধুরী
জেসাস খুব সুক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রার্থনাকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি ঈশ্বরকে বলতেন ‘আভা’। খ্রিস্টানরা ‘আভা’কে অনুবাদ করে ‘পিতা’ হিসেবে। এটা একেবারেই ভুল : ‘আভা’ পিতা নয়। ‘আভা’কে শুধু পাপা, অথবা ডেড-ডেডি ইত্যাদী অনুবাদ করা যেতে পারে, কিন্তু পিতা নয়। আর তিনি ছিলেন জেসাস যিনি আভাকে পরিচিত করিয়েছিলেন; তাঁর আগে কোনো ইহুদি এই পদ্ধতিতে প্রার্থনা করেনি। ঈশ্বর ছিলেন পিতা। ঈশ্বরকে আভা, ডেডি ইত্যাদি নামে ডাকাটাকে কেমন যেন অপবিত্র ঠেকছিল। কিন্তু এই ডাক ছিল অধিকতর স্বতঃস্ফূর্ত, অন্তরঙ্গ, নিজস্ব।
ঈশ্বরকে ‘পিতা’ ডাকা ঠিক নয়। ‘পিতা’ ডাকটি খুব রোগা মনে হয়, ভালোবাসাহীন, অন্তরঙ্গতাহীন, দূরের। এই ডাকের মধ্য দিয়ে ভালোবাসার প্রবাহ টের পাওয়া যায় না। ‘পিতা’ হচ্ছে একটা প্রাতিষ্ঠানিক শব্দ। ‘পাপা’ ডাকটি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। ইহুদিরা খুব ক্রুদ্ধ হয়েছিল, যখন তারা শুনল যে, জেসাস ঈশ্বরকে ‘আভা’ সম্বোধন করছেন : ‘সে কে? সে নিজেকে কি ভাবে?’ তারা তাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। জেসাসের প্রার্থনা ছিল খুবই স্বতঃস্ফূর্ত। এই ব্যাপারে তাঁর নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম ছিল না। কখনো কখনো হঠাৎ করে তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ‘এখন আমাকে প্রার্থনার জন্য যেতে হবে, আমার মাঝে প্রার্থনার অনুভূতি কাজ করছে।’ কখনো তিনি জনতার মাঝে কথা বলছেন, তাদেরকে শিক্ষা দান করছেন এবং হঠাৎ তিনি তাঁর শিষ্যদের বলছেন, ‘এখনো আমাকে কোনো নির্জন স্থানে প্রার্থনার জন্য যেতে হবে।’
এটা কোনো ধর্মীয় আচার নয়, এটা একটা বোধ। এটা মস্তিষ্ক খাটিয়ে করার জিনিস নয়। যখন হৃদয়ে এই প্রার্থনার অনুভূতি আসে, তখন একে উপচে পড়তে দাও। কখনো তুমি মৌন থাকতে পারো, হয়তো কিছুই বোধ হবে না, শুধু মৌনতাই থাকবে। অন্যসব কিছুর মতো মৌনতাও প্রার্থনাময়, এমনকি ভাষার চেয়েও আরো বেশি প্রার্থনাময়, কিন্তু এই বোধের জন্য জোরাজুরি করো না, এটা কোনো দক্ষতার ব্যাপার নয়। হৃদয়ে যা আসে তাই বলো, এটাকে আরো বেশি জাকজমকপূর্ণ করার চেষ্টা করো না। প্রার্থনা চর্চার বিষয় নয়। প্রার্থনাকে পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত হতে দাও। এটাকেই কবির বলেছেন ‘সহজ’ স্বতঃস্ফূর্ত। আর তিনি বলেন, যদি তুমি স্বতঃস্ফূর্ত থাকো, অচিরেই তুমি ‘সমাধি’তে উপনীত হবে। অচিরেই তোমার ভেতর থেকে সবকিছু উধাও হয়ে যাবে—সেখানে থাকবে এক আশ্চর্য সুন্দর শূন্যতা, যখন কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। আর শুধু এই রকম শূন্যতার মাঝেই ঈশ্বর নেমে আসেন, আর তুমি পরিপূর্ণ হও।
একেই তিনি বলেন, ‘সহজ সমাধী’ স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। আর তিনি বলেন যে তোমার পুরো জীবন প্রার্থনাময় হওয়া উচিত। ধর্ম জীবনের আলাদা কোনো একটি অংশ নয়, তোমার পুরো জীবনটাই হওয়া উচিত ধর্ম। এমন না যে, ভোরবেলায় তুমি তোমার প্রার্থনা করলে আর তোমার ধর্ম অবসর পেয়ে গেল; অথবা রোববারে তুমি গীর্জায় গেলে, আর বাকি ছয় দিনের জন্য তুমি ধর্ম থেকে মুক্ত হয়ে গেলে।
ধর্ম, যদি এটাকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে চাও, তবে নিজের মাঝে একে নিরন্তর জারি রাখতে হবে। খাওয়া, হাঁটা, কথা বলা, কথা শোনা ইত্যাদি সবকিছুই প্রার্থনাময় হওয়া উচিত। প্রার্থনাকে ছড়িয়ে দাও কাজে এবং নিষ্কর্ম অবস্থায়। নিদ্রা, এটাও হওয়া উচিত প্রার্থনাময়।
তখনই কেবল প্রাকৃতিক পরমানন্দের উদয় হবে। আর কবির ছিলেন দারুণভাবে প্রাকৃতিক পরমানন্দের প্রেমিক। তিনি বলেন : পৃথিবীতে দুই ধরনের পরমানন্দ আছে। এক : চর্চিত, জোরপূর্বক; যোগীরা এইটা করে—অঙ্গভিঙ্গ আর নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে। তারা নিজেদেরকে এইটার জন্য প্রস্তুত করে। এটা অনেক কঠিন কসরতের মাধ্যমে আয়ত্ব করা একটা জিনিস। আর কবির বলেন, শেখানো জিনিস ভিত্তিহীন হতে বাধ্য। এটা হচ্ছে একটা কর্মকৌশল।
তিনি বলেন, ‘শান্ত, সহজ সমাধি ভালো।’
ও সাধক, ও শিষ্যগণ, স্বতঃস্ফূর্ত পরমানন্দই উত্তম। তোমাদের এটা চর্চা করা উচিত নয়। চর্চার মাধ্যমে এটাকে তোমরা বিষাক্ত করে তোলো। একে পাবার জন্য তোমাদের নাটকীয় কিছু করা উচিত নয়। তোমাদের নিরুদ্বেগ থাকে উচিত এবং অচিরেই ধীরে ধীরে তোমরা এর মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।
কে তাঁর ঘরে জায়গা দেবে একজন সংসারবিবাগী।
ঘরই হচ্ছে সত্যিকারের মিলনক্ষেত্র,
ঘরেই রয়েছে জীবনের আনন্দ :
কেন আমি আমার ঘর ছেড়ে বনবাসী হতে যাবো?
যদি ব্রহ্মা আমায় সত্য অনুধাবন করান,
নিশ্চয়ই এই ঘরেই পাবো আমি আমার
বন্ধন এবং মুক্তি।
তিনি ছিলেন ভীষণভাবে ঘরপ্রেমিক।
তিনি ভীষণভাবে ঘরপ্রেমিক। তিনি বলেন, ঘর ছেড়ে যেয়ো না, আর সংসারবিবাগী হয়ো না, নিজের উপর নির্যাতন করো না। পরিবারের সাথে থাকো। ঈশ্বর প্রদত্ত অবস্থা পরিবর্তন করার চেষ্টা করো না; একে গ্রহণ করো। ঈশ্বর যা’ই দেন তা ভালো : গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে একে গ্রহণ করো। একে গ্রহণ না-করা মানে ঈশ্বরকে গ্রহণ না-করা। মা, বাবা, ভাই, স্ত্রী, সন্তান—প্রাকৃতিকভাবে যে সম্পর্কগুলো হয়েছে সেগুলোকে সেভাবেই থাকতে দাও। কোনো কৃত্রিম অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করো না, কারণ কৃত্রিমতার মধ্য দিয়ে তুমি কখনো প্রকৃতিতে পৌঁছুতে পারবে না। কেউই আত্মবঞ্চনাকারী হিসেবে জন্ম নেয় না, কেউই বৈরাগী হিসেবে জন্ম নেয় না। সবাই’ই পরিবারের মাঝেই জন্ম নেয়, সমাজের মাঝে জন্ম নেয়; সবাই’ই মা-বাবার থেকে জন্ম নিয়ে থাকে। সকলেই ভালোবাসার আবহে জন্ম নেয়। বৈরাগ্য হচ্ছে মানুষের আবিষ্কার, পরিবার হচ্ছে স্বর্গীয়।
অবশ্যই সে আমার প্রিয় একজন,
যে সংসারবিবাগীকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারে।
যদি তিনি এখানে থাকতেন, অবশ্যই তিনি আমাকে ভালোবাসতেন। আমি অনেক সংসারবিবাগীকে ফিরিয়ে এনেছি। আমি তাদেরকে সেখানে থাকতে সহায়তা করেছি, যেখানে তারা ছিল; বাইরের পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন না-করে, কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করে। পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন করতে চাওয়া মনের একটি প্রতারণা। এটা কোনো সাহায্য করবে না। তোমার সচেতনতাকে পরিবর্তন করো।
ঘরেই রয়েছে সত্যিকারের ঐকতান,
ঘরেই রয়েছে জীবনের উদযাপন
কেন আমি আমার ঘর ত্যাগ করতে যাবো
আর সংসারবিবাগী হয়ে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো?
যদি ঈশ্বর আমাকে সত্য অনুধাবন করাতে চান,
নিশ্চয়ই ঘরেই আমি পাবো দাসত্ব এবং মুক্তি।
হ্যাঁ, ঘর হচ্ছে দাসত্ব এবং ঘর মুক্তিও বটে। এটা তোমার উপর নির্ভর করে। যদি তুমি ঘরের বিরুদ্ধ হও, তবে এটি দাসত্বরূপে প্রকাশ পাবে; আর যদি তুমি এর বিরুদ্ধ না হও, এটা হবে তোমার জন্য মুক্তি। এটা মূলত তোমার দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নির্ণিত হবে। এমনকি শিকলও হতে পারে মুক্তির উপকরণ; এটা তোমার উপর নির্ভর করে। আর তুমি শিকলকেও বানাতে পারো তোমার স্বাধীনতার উপকোণ।
প্রকৃতপক্ষে সে’ই আমার প্রিয়
যার ঈশ্বরের মাঝে ঝাঁপ দেয়ার সাহস আছে;
যার মন অবলীলায় হারিয়ে যায় তাঁর চিন্তার গভীরে।
সেই আমার প্রিয় যে ঈশ্বরকে চেনে,
এবং ধ্যানের গভীরে তাঁকে
সর্বোচ্চ সত্যি হিসেবে অধিষ্ঠিত করতে পারে;
এবং যে অনন্তের সংগীত গাইতে পারে
জীবনে ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ঐকতানের মাধ্যমে।
এটাই সর্বোচ্চ সাদৃশ্য : ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ঐকতান। লোকেরা আমার কাছে আসে এবং বলে, ‘তুমি একটা নতুন ধরনের বৈরাগ্যের উদ্ভাবন করেছো, যারা ঘরে থাকে; তাহলে এরা কি ধরনের বৈরাগী?’ কারণ পুরনো ধ্যান-ধারণা হলো, যারা সন্ন্যাসী হয় তারা দুনিয়াদারী ছেড়ে দেয়, পরিবার ছেড়ে যায়, বনবাসী হয়, সংসারবিবাগী জীবনযাপন করে। ‘তাহলে কিভাবে তুমি তোমার লোকদের সন্ন্যাসী বলো, যদি তারা গৃহত্যাগ না-করে, যদি তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের সাথে থাকে, আর যদি তারা প্রেমের মাঝে জীবনযাপন করে, তাহলে তুমি কিভাবে তাদেরকে সন্ন্যাসী বলো?’
আমি তাদেরকেই প্রকৃত সন্ন্যাসী বলি, পুরনো টাইপের চেয়েও বেশি প্রকৃত, কারণ পুরনো টাইপের সন্ন্যাস প্রকৃতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সে বিভক্ত। সে সম্পূর্ণ নয়, সে আংশিক সন্ন্যাসী।
আমার নতুন সন্ন্যাসীরা সম্পূর্ণ : তারা আত্মত্যাগী, কিন্তু সংসারবিবাগী নয়। তাদের বসবাস প্রেমের মাঝে, কিন্তু তারা প্রেমাসক্ত নয়; এটাই তাদের আত্মত্যাগ। তারা পৃথিবীতে ভালোবাসার মাঝে বাঁচে, কিন্তু তারা ভালোবাসার দখলদার নয়; এটাই তাদের আত্মত্যাগ। তারা ভালোবাসার মাঝে বাঁচে, কিন্তু তারা ঈর্ষাকাতর নয়; এটাই তাদের আত্মত্যাগ। তারা বস্তু ব্যবহার করে, কিন্ত বস্তুর তারা ব্যাবহৃত হয় না; এটাই তাদের আত্মত্যাগ। তারা সৃষ্টির মাঝে স্রষ্টাকে খুঁজে পায়, আর তারা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে আলাদা করে না; তারা কোনো বিভক্তি সহ্য করে না। তারা বৈপরীত্যের মাঝেও সাদৃশ্য খুজে নেয়।
(চলবে)
The path of love : Osho Rajneesh. প্রেমের সরল পথ (দি পাথ অব লাভ) : ওশো রজনীশ
ধারাবাহিকভাবে পড়তে বিষয়ে ক্লিক করুন
দি পাথ অব লাভ – ১
দি পাথ অব লাভ – ২
দি পাথ অব লাভ – ৩
দি পাথ অব লাভ – ৪
দি পাথ অব লাভ – ৫
৪ thoughts on “দি পাথ অব লাভ : ওশো রজনীশ : ৩”