Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Shundor - Rabindranath Tagore

Shundor - Rabindranath Tagore

সুন্দর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

[নাট্যগীতি]

 

নুটু। রানী, এখনো তো দোলপূর্ণিমার দেরি আছে।

অমিতা। বসন্তিকা, তাতে ক্ষতি কী?

নুটু। এখনো শীত রয়েছে যে। বসন্তের গান কি এখন—

অমিতা। এই তো সময়। শীতের হৃদয়ের মধ্যেই বসন্তের ধ্যানমূর্তি।

নুটু। হৃদয়ের ভিতর কী আছে তা তোমার কবিই জানে। কিন্তু বাইরের দিকে চেয়ে দেখো সমস্ত পাতা যে ঝরিয়ে দিলে।

অমিতা। নবীনের জন্যে নূতন করে আসন পাতবার ভার নিয়েছে শীত।

নুটু। কিন্তু বনের মধ্যে যেন ডাকাত পড়েছে— নিষ্ঠুর তার কাজ।

অমিতা। বসন্তিকা, সুন্দরকে যদি চাস তো তার সাধনা কঠোর সে-কথা মনে রাখিস। শীতের কাজ বড়ো কঠোর, সমস্ত উজাড় করে দিয়ে তবে সে সুন্দরকে পায়।

নুটু। তা ভালো। কিন্তু এই তো তোমার পুঁথি। সুন্দরের পালা এতে তো সমস্তটা নেই। ছাড়া ছাড়া কতকগুলো গান। এ কি ভালো হবে?

অমিতা। কবিকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। কবি বললেন, এ কি যুদ্ধ পেয়েছ রানী, যে সৈন্য একেবারে দলেবলে এসে দুর্গ দখল করবে? সুন্দরের দূত এখানে-ওখানে একটি-দুটি করে আসে, উঁকি মেরে যায়। দেখিস নি আমাদের বাগানে কোথাও বা দুটো-একটা অশোকের কুঁড়ি ধরেছে, কোথাও বা একটি-দুটি মাধবী ফোটে-ফোটে করছে— সবই খাপছাড়া। কিন্তু সেই অল্পটুকুতেই অনেকখানির ভূমিকা।

নুটু। এটা কবির কুঁড়েমি। সমস্তটা লিখতে মন যাচ্ছে না— কোনোমতে গোটাকতক গান বানিয়ে দিয়ে কাজ সারতে চান।

অমিতা। কবি বলেছেন, পালা অভিনয় হতে হতে দিনে দিনে সমস্ত গান যখন সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, তখন দোলপূর্ণিমা এসে পড়বে। অশোকবনেরও সেই নিয়ম, পলাশবনেরও সেই রীতি;তাদের উৎসব জমে উঠতে সময় লাগে। কিন্তু আর তোকে ব্যাখ্যা করতে পারি নে। এইবার আরম্ভ হোক। সবাইকে ডাক-না।

নুটু। সবাই প্রস্তুত আছে। আচার্য সুরেশ্বর, ধরো তোমার যন্ত্র। মঞ্জুলা গান আরম্ভ করো।

অমিতা। ও কি? শুধু গান, সে হবে না।

নুটু। আর কি চাই রানী?

বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।

স্থল জলে নভতলে বনে উপবনে

নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে

নিত্য জাগে সরস সংগীতমধুরিমা,

নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।

নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।

অমিতা। নৃত্য দিয়ে শুরু করতে হবে। সুন্দরের পালা যে বসন্তের।

নুটু। তা হোক-না— কিন্তু তাই বলে অসংযম—

অমিতা। অসংযম? একে বলে উল্লাস। বসন্তের শুরুতেই দক্ষিণে-হাওয়া আসে বনে-বনান্তরে নৃত্য প্রচার করে বেড়ায়। ফুল ফোটে, পাখি গায়, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বন নৃত্যবেগে দুলতে থাকে। সুন্দর আর নটরাজ যে একই। কবির কাছে সেদিন শুনলি নে নাচেতেই নিখিল জগতের প্রকাশ— নাচ বন্ধ হলেই প্রলয়। যমুনাকে জাহ্নবীকে বলে দে তাদের দুজনের নৃত্যতরঙ্গের লীলা এক জায়গায় মিলিয়ে দিক— আজ আমার এই আঙিনায় নৃত্যের পবিত্র প্রয়াগতীর্থ রচনা হোক— এইখানে নটরাজের পূজা।

নুটু। আচার্য সুরেশ্বর তাদের আগে থাকতেই প্রস্তুত করে রেখেছেন দেখছি— ওই যে তারা আসছে।

নৃত্যের তালে তালে, নটরাজ             ঘুচাও ঘুচাও ঘুচাও সকল বন্ধ হে।

সুপ্তি ভাঙাও, চিত্তে জাগাও             মুক্ত সুরের ছন্দ হে॥

তোমার চরণপবনপরশে                 সরস্বতীর মানসসরসে

যুগে যুগে কালে কালে                  সুরে সুরে তালে তালে

ঢেউ তুলে দাও, মাতিয়ে জাগাও অমলকমল গন্ধ হে॥

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥

নৃত্যে তোমার মুক্তির রূপ,                   নৃত্যে তোমার মায়া,

বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।

তোমার বিশ্ব-নাচের দোলায় দোলায়     বাঁধন পরায় বাঁধন খোলায়

যুগে যুগে কালে কালে          সুরে সুরে তালে তালে,

অন্ত কে তার সন্ধান পায় ভাবিতে লাগায় ধন্দ হে।

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥

নৃত্যের বসে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,

পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।

তব নৃত্যের প্রাণবেদনায় বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়

যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে,

সুখে দুখে হয় তরঙ্গময় তোমার পরমান্দ হে।

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥

 

মোর সংসারে তাণ্ডব তব কম্পিত জটাজালে।

লোকে লোকে ঘুরে এসেছি তোমার নাচের ঘূর্ণিতালে।

ওগো সন্ন্যাসী, ওগো সুন্দর,       ওগো শঙ্কর হে ভয়ংকর

যুগে যুগে কালে কালে        সুরে সুরে তালে তালে

জীবন-মরণ-নাচের ডমরু বাজাও জলদমন্দ্র হে।

নমো নমো নমো—

তোমার নৃত্য অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম॥

 

নুটু। নাচ তো হল রানী। এবার পুঁথিতে কী লিখছে?

অমিতা। এবারে দ্বিধার গান। সুন্দর তো আসছেন, কিন্তু মনে ভয় হয় তিনি কি আমাকে আপন বলে চিনে নেবেন?

নুটু। চিনতে দেরি হবে কেন, রানী?

অমিতা। এখনো আমার মধ্যে যে রঙ লাগে নি।

নুটু। কবে লাগবে?

অমিতা। যখন তিনি আপন রঙে রাঙিয়ে দেবেন। মঞ্জরী এসো, ধরো গান।

দি তারে নাই চিনি গো সে কি আমায় নেবে চিনে

এই নব ফাল্গুনের দিনে— জানি নে, জানি নে।

সে কি আমার কুঁড়ির কানে      কবে কথা গানে গানে,

পরান তাহার নেবে কিনে      এই নব ফাল্গুনের দিনে

জানি নে,   জানি নে॥

সে কি আপন রঙে ফুল রাঙাবে।

সে কি মর্মে এসে ঘুম ভাঙাবে।

ঘোমটা আমার নতুন পাতার হঠাৎ দোলা পাবে কি তার,

গোপন কথা নেবে জিনে,    এই নব ফাল্গুনের দিনে—

জানি নে, জানি নে॥

অমিতা। কিন্তু সময় যে যায়। সুন্দর আসবেন কখন? এখনো তো শূন্য রয়েছে আসন ওলো কলিকা— ভৈরবীতে বেদনার সুর লাগিয়ে দে।

নুটু। রানী, আজ আবার বেদনা কেন? আজ ভৈরবী থাক্‌— আজ সাহানা।

অমিতা। প্রতীক্ষার চোখের জলে মন যখন খুব করে ভিজে যায় তখনি মিলনের ফুল সম্পূর্ণ করে ফুটে ওঠে। কালিকা, এইবার ওই গানটা—

‘তোমায় চেয়ে আছি’ বসে পথের ধারে সুন্দর হে।

জমল ধুলা প্রাণের বীণার তারে তারে সুন্দর হে॥

নাই যে কুসুম, মালা গাঁথব কিসে! কান্নার গান বীণায় এনেছি যে,

দূর হতে তাই শুনতে পাবে অন্ধকারে সুন্দর হে।

দিনের পরে দিন কেটে যায় সুন্দর হে।

মরে হৃদয় কোন্‌ পিপাসায় সুন্দর হে।

শূন্য ঘাটে আমি কী-যে করি—       রঙিন পালে কবে আসবে তরী,

পাড়ি দেব কবে সুধারসের পারাবারে সুন্দর হে॥

অমিতা। না, শুধু অমন করে পথ চেয়ে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে চলবে না। শীতের অরণ্য যেমন তার সমস্ত উৎসুক শাখা আকাশে তুলে ডাক দেয় তেমনি করে ডাকতে হবে।

নুটু। রানী, অত বেশি ডাকাডাকি করে আনতে গেলে মান থাকে না।

অমিতা। কী যে বলিস বসন্তিকা, তার মানে নেই। নিজের মান নিয়ে করব কী! মান আমার ভেসে যাক্‌-না, মান যেন তারি থাকে।

নুটু। কিন্তু ডাকতে হয় কেন রানী বুঝতে পারি নে। যার দেবার সে অমনি দিয়ে যায় না কেন!

অমিতা। সে যত বড়ো দাতাই হোক-না কেন, সে তার সাধ্য নেই। ডাকতে পারি বলেই সে দিতে পারে। বন বৃষ্টিকে চায় বলেই মেঘ বৃষ্টি দিয়ে সার্থক হয়, মরুভূমিকে দিতে পারে এমন উপায় তার হাতে নেই। সে-কথা পরে হবে। এখন এসো তো তোমরা, শুধু গানের ডাক নয় নাচের ডাক ডাকো— কণ্ঠ দিয়ে অঙ্গ দিয়ে-দেহের সমস্ত রক্তে ডাকের ঢেউ উঠতে থাক্‌— ধরো—

আজি দখিন-দুয়ার খোলা—

এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।

দিব হৃদয় দোলায় দোলা,

এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো।

নব শ্যামল শোভন রথে এসো বকুলবিছানো পথে,

এসো বাজায়ে ব্যাকুল বেণু মেখে পিয়ালফুলের রেণু।

এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥

এসো ঘনপল্লবপুঞ্জে এসো হে, এসো হে এসো হে।

এসো বনমল্লিকাকুঞ্জে এসো হে, এসো হে, এসো হে।

মৃদু মধুর মদির হেসে      এসো পাগল হাওয়ার দেশে,

তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিয়ো—

এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো।

অমিতা। এবার এসো তো নন্দিনী। তোমার দুটি চক্ষু আকাশের আলোতে দুটি অপরাজিতার মতো ফুটে উঠেছে। তোমার তো ভয় নেই, দ্বিধা নেই। তুমি সহজ বিশ্বাসেই মনে নিশ্চিত ঠিক করেছ সুন্দর তোমাকে বর দেবেনই। যাকে তিনি নিজে বেছে নেন তার আর ভাবনা কী। দখিন হাওয়ার ছোঁওয়া বুঝি লাগল তোমার উপবনে। সুন্দর তোমার বনের শাখায়-শাখায় নাচের ছন্দ নিজে এনে দিয়েছেন।

নুটু। রানী, ওর মনে ভয় নেই বলেই বুঝি ভুল আছে। নিজের সৌভাগ্য ও কি জানে? কোথায় বসে বুঝি খেলছে।

অমিতা। ওগো নন্দিনী, ওই যে গান উঠেছে।

ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, দোদুল দোলায় দাও দুলিয়ে।

নূতন-পাতার-পুলক-ছাওয়া পরশখানি দাও বুলিয়ে।

আমি   পথের ধারে ব্যাকুল বেণু হঠাৎ তোমার সাড়া পেনু গো—

আহা, এসো আমার শাখায় শাখায় প্রাণের গানের ঢেউ তুলিয়ে॥

ওগো দখিন হাওয়া, ও পথিক হাওয়া, পথের ধারে আমার বাসা।

জানি তোমার আসা-যাওয়া শুনি তোমার পায়ের ভাষা।

আমায়   তোমার ছোঁওয়া লাগলে পরে একটুকুতেই কাঁপন ধরে গো—

আহা, কানে কানে একটি কথায় সকল কথা নেয় ভুলিয়ে॥

এবার আনো তোমার নব কিশলয়ের নাচ।

নুটু। রানী, সুন্দর যাকে আপনি এসে বর দেন আমরা তো সে দলের লোক নই।

অমিতা। এমন কথা বলিস নে বসন্তিকা। আমাদেরও ক্ষণে ক্ষণে ছোঁওয়া লাগে। আমরা পাই আবার হারাই। দানের ধর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে যায়। সমস্ত জীবন ধরে সেইগুলিকেই কুড়িয়ে কুড়িয়ে গেঁথে রাখি, সেই কি কম ভাগ্য? তুই যা তো, বল্লরীকে ওই গানটা ধরিয়ে দে—

একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি

তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।

কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা,

তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥

যেটুকু কাছেতে আসে ক্ষণিকের ফাঁকে ফাঁকে

চকিত মনের কোণে স্বপনের ছবি আঁকে।

যেটুকু যায় রে দূরে ভাবনা কাঁপায় সুরে,

তাই নিয়ে যায় বেলা নূপুরের তাল গুনি॥

অমিতা। বসন্ত এসেছেন।

নুটু। কই রানী, এখনো তো দেখতে পাচ্ছি নে।

অমিতা। কোথায় দেখছিস তুই? অন্তরের ভিতরে চেয়ে দেখ-না।

নুটু। সেখানে কী যে আছে সে আরো চোখে পড়ে না। কবি আমাকে গান দিয়েছেন গাইতে পারি কিন্তু দৃষ্টি তো দেন নি।

অমিতা। নিজের কথাটা একটু কম করে বলাই তোর অভ্যাস। আমি জানি তোর অন্তরের মধ্যে চেতনার জোয়ার এসেছে। নন্দন পথযাত্রার আহ্বান জেগেছে। যা, আর দেরি না— সবাইকে ডাক, আবাহন-গান হোক— দেখতে দেখতে সময় যে চলে যায়।

এস        এস বসন্ত ধরাতলে।

আন      মুহু মুহু নব তান, আন নব প্রাণ নব গান।

আন      গন্ধমদভরে অলস সমীরণ

আন      বিশ্বের অন্তরে অন্তরে নিবিড় চেতনা।

আন      নব উল্লাসহিল্লোল

আন      আন আনন্দ ছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।

ভাঙ      ভাঙ বন্ধন শৃঙ্খল

আন      আন উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে

এস        থরথরকম্পিত মর্মরমুখরিত নবপল্লবপুলকিত

ফুল-      আকুল মালতীবল্লিবিতানে— সুখছায়ে মধুবায়ে।

এস        বিকশিত উন্মুখ, এস চির-উৎসুক নন্দনপথচিরযাত্রী।

এস        স্পন্দিত নন্দিত চিত্তনিলয়ে গানে গানে, প্রাণে প্রাণে।

এস        অরুণচরণ কমলবরণ তরুণ উষার কোলে।

এস        জ্যোৎসনাবিবশ নিশীথে, কলকল্লোল তটিনী-তীরে,

সুখ        সুপ্ত সরসী-নীরে। এস এস।

এস        তড়িৎ-শিখা-সম ঝঞ্ঝাচরণে সিন্ধুতরঙ্গদোলে।

এস        জাগর মুখর প্রভাতে

এস        নগরে প্রান্তরে বনে।

এস        কর্মে বচনে মনে। এস এস।

এস        মঞ্জীরগুঞ্জর চরণে।

এস        গীতমুখর কলকণ্ঠে।

এস        মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।

এস        কোমল কিশলয়বসনে।

এস        সুন্দর, যৌবনবেগে।

এস        দৃপ্ত বীর, নবতেজে।

ওহে       দুর্মদ, কর জয়যাত্রা,

চল        জরাপরাভব সমরে

পবনে কেশ রেণু ছড়ায়ে,

চঞ্চলে কুন্তল উড়ায়ে॥

নুটু রানী, তুমি যাই বলো, এখনো দেরি আছে।

অমিতা। তুই বড়ো ভীরু! একান্ত মনে বিশ্বাস করে যদি বলি, এসেছেন, এসেছেন, এসেছেন, তাহলে তিনি আসেন। তাঁর আসবার পথ আমাদের এই বিশ্বাস।

নুটু। বিশ্বাস জোর করে তো হয় না।

অমিতা। জোর চাই, জোর চাই। যে দুর্বল সে হাতে পেয়েও পায় না। এসো তো লতিকা, তোমার সেই সাহসের গান গাও। বলো, তোমার যদি আসতে দেরি থাকে, আমি এগিয়ে গিয়ে নিয়ে আসব।– বলো,

কবে তুমি আসবে বলে রইব না বসে, আমি চলব বাহিরে।

শুকনো ফুলের পাতাগুলি পড়তেছে খসে, আর সময় নাহি রে।

বাতাস দিল দোল, দিল দোল;

ও তুই     ঘাটের বাঁধন খোল্‌, ও তুই খোল্‌।

মাঝ-নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে তরী বাহি রে॥

আজ     শুক্লা একাদশী, হেরো নিদ্রাহারা শশী

ওই      স্বপ্নপারাবারের খেয়া একলা চালায় বসি।

তোর      পথ জানা নাই, নাইবা জানা নাই—

ও তোর   নাই মানা নাই, মনের মানা নাই—

সবার সাথে চলবি রাতে সামনে চাহি রে।

নুটু। কিন্তু রানী এখনো তো সাড়া পাচ্ছি নে।

অমিতা। নিশ্চয় পাচ্ছি। বুঝতে সময় লাগে— ভুল বুঝেই কত দিন কেটে যায়।

নুটু। যদি ভুল বুঝি যে সে কি আমার দোষ? ভোলান কেন?

অমিতা। ভুল ভাঙাবার সুখ দেবেন বলে। ওই যে শুকনো পাতা ছড়িয়ে চলেছেন তুই শুধু কি তাই দেখবি।

নুটু। যা চোখের সামনে দেখান তাই দেখি।

অমিতা। যা চোখের সামনে দেখান তাই দেখি।

অমিতা। যা চোখের সামনে দেখান না, তাই আরো বেশি করে দেখবার। মন দিয়ে একবার চেয়ে দেখ— ঐ শুকনো পাতার আবরণ এখনি খসবে— চিরনবীন ওরই আঁড়াল থেকে দেখা দেন। ওগো কিশোরের দল ধরো তো—

শুকনো পাতা কে যে ছড়ায় ওই দূরে উদাস করা কোন্‌ সুরে॥

ঘরছাড়া ওই কে বৈরাগী      জানি না যে কাহার লাগি

ক্ষণে ক্ষণে শূন্যে বনে যায় ঘুরে॥

চিনি চিনি যেন ওরে হয় মনে,

ফিরে ফিরে যেন দেখা ওর সনে।

ছদ্মবেশে কেন খেলো জীর্ণ এ বাস ফেলো—

প্রকাশ করো চিরনূতন বন্ধুরে॥

নুটু। রানী, ছদ্মবেশ ঘোচে, মায়া কাটে,দেখাও দেন। কিন্তু সব চেয়ে দুঃখ যে সম্পূর্ণ করে ধরা দেন না।

অমিতা। এই তো প্রেমের খেলা। পাওয়া আর না পাওয়ার দোল— এই হল দোলপূর্ণিমার দোল। সত্য আর মায়ার একসঙ্গে লীলা।

নুটু। এমন লীলায় ফল কী!

অমিতা। যেদিন দিয়ে তিনি চলে চলে যান সেই ব্যথার পথেই আমাদের এগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যান। সুমনা, সুন্দরের বিদায়ের পালা এবার শুরু হোক।

কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যায়, শেষে দাও মুছে।

ওহে চঞ্চল, বেলা না যেতে খেলা কেন তব যায় ঘুচে॥

চকিত চোখের অশ্রুজল বেদনায় তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল—

কোথা সে পথের শেষ কোন্‌ সুদূরের দেশ

সবাই তোমায় তাই পুছে॥

বাঁশরির ডাকে কুঁড়ি ধরে শাখে, ফুল যবে ফোটে নাই দেখা।

তোমার লগন যায় যে কখন, মালা গেঁথে আমি রই একা।

‘এসো এসো এসো’ আঁখি কয় কেঁদে। তৃষিত বক্ষ বলে ‘রাখি বেঁধে’।

যেতে যেতে ওগো প্রিয়, কিছু ফেলে রেখে দিয়ো

ধরা দিতে যদি নাই রুচে॥

 

ও কি এল ও কি এল না, বোঝা গেল না—

ও কি মায়া কি স্বপনছায়া ও কি ছলনা॥

ধরা কি পড়ে ও রূপেরই ডোরে,

গানেরই তানে কি বাঁধিবে ওরে—

ও যে চিরবিরহেরই সাধনা॥

ওর বাঁশিতে করুণ কী সুর লাগে

বিরহমিলনমিলিত রাগে।

সুখে কি দুখে ও পাওয়া না পাওয়া,

হৃদয়বনে ও উদাসী হাওয়া,

বুঝি শুধু ও পরম কামনা॥

অমিতা। এই প্রেমের খেলার রস তো এই। তীব্র সে, মধুর সে। যখন পেয়েছি তখনো ভয় থাকে,কখন হারাই কখন হারাই। দান যখন পূর্ণ করে নিয়ে আসেন তখনো মনের মধ্যে আশঙ্কা বাজে—

কবে যে সব ফুরিয়ে দেবে, চলে যাবে দেশান্তরে॥

পথিক, তোমায় আছে জানা, করব না গো তোমায় মানা—

যাবার বেলায় যেয়ো যেয়ো বিজয়মালা মাথায় প’রে।

তবু তুমি আছ যতক্ষণ

অসীম হয়ে ওঠে হিয়ায় তোমারি মিলন।

যখন যাবে তখন প্রাণে      বিরহ মোর ভরবে গানে—

দূরের কথা সুরে বাজে সকল বেলা ব্যথায় ভরে।

তখন সিন্ধু ভৈরবীতে কান্না দুলে দুলে উঠতে থাকে—

না, যেয়ো না, যেয়ো নাকো॥

মিলনপিয়াসী মোরা— কথা রাখো কথা রাখো।

আজো বকুল আপনহারা হায় রে, ফুল-ফোটানো হয় নি সারা,

সাজি ভরে নি—

পথিক ওগো থাকো থাকো॥

চাঁদের চোখে জাগে নেশা,

তার আলো গানে গন্ধে মেশা।

দেখো চেয়ে কোন্‌ বেদনায়      হায় রে     মল্লিকা ওই যায় চলে যায়

অভিমানিণী

পথিক, তাকে ডাকো ডাকো।

এই কান্নার দোল এও সেই দোলপূর্ণিমার দোল। জীবনের পরম সম্পদ চরম আশা দেখা দিয়ে যে চলে যায়। কিন্তু গেলেও সে যেতে পারে না। তার বিচ্ছেদের আলো জলে স্থলে আকাশে জ্বলে ওঠে। মন বলতে থাকে আমার বিরহের বীণা তোমাকেই নিবেদন করে দিলুম। এই বীণায় তোমার নন্দনের সুর এনে দাও। সেই নন্দনের সুর যা মর্ত্যের ওপার থেকে আসে—যেখান থেকে অরুণের আলো আসে— যেখান থেকে হঠাৎ নবজীবনের দূত দেখা দেয় মৃত্যুর তোরণ পার হয়ে।

এনেছ ওই শিরীষ বকুল আমের মুকুল সাজিখানি হাতে করে।

কবে যে সব ফুরিয়ে দেবে, চলে যাবে দিগন্তরে॥

পথিক, তোমায় আছে জানা, করব না গো তোমায় মানা—

যাবার বেলায় যেয়ো যেয়ো বিজয়মালা মাথায় পরে॥

তবু তুমি আছ যতক্ষণ

অসীম হয়ে ওঠে হিয়ায় তোমারি মিলন।

যখন যাবে তখন প্রাণে বিরহ মোর ভরবে গানে—

দূরের কথা সুরে বাজে সকল বেলা ব্যথায় ভরে॥

 

ও দেখা দিয়ে যে চলে গেল,     ও চুপি চুপি কী বলে গেল।

যেতে যেতে গো, কাননেতে গো      ও কত যে ফুল দলে গেল॥

মনে মনে কী ভাবে কে জানে,     মেতে আছে ও যেন কী গানে,

নয়ন হানে আকাশ পানে— চাঁদের হিয়া গলে গেল।

ও পায়ে পায়ে যে বাজায়ে চলে      বীণার ধ্বনি তৃণের দলে।

কে জানে কারে ভালো কি বাসে,     বুঝিতে নারি কাঁদে কি হাসে,

জানি নে ও কি ফিরিয়া আসে— জানি নে ও কি ছলে গেল।

লহো লহো তুলে লহো নীরব বীণাখানি।

তোমার নন্দন নিকুঞ্জ হতে সুর দেহো তায় আনি

ওহে সুন্দর হে সুন্দর॥

আমি আঁধার বিছায়ে আছি রাতের আকাশে

তোমারি আশ্বাসে।

তারায় তারায় জাগাও তোমার আলোক-ভরা বাণী

ওহে সুন্দর হে সুন্দর॥

পাষাণ আমার কঠিন দুখে তোমায় কেঁদে বলে,

‘পরশ দিয়ে সরস করো ভাসাও অশ্রুজলে,

ওহে সুন্দর হে সুন্দর।’

শুষ্ক যে এই নগ্ন মরু নিত্য মরে লাজে

আমার চিত্ত মাঝে,

শ্যামল রসের আঁচল তাহার বক্ষে দেহো টানি

ওহে সুন্দর হে সুন্দর॥

 

রবীন্দ্রবীক্ষা

দ্বাদশ সংকলন

[১৩৩৫]

৭ই পৌষ ১৩৯১

 

-o-

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।