Sahittya

Literature magazine | Bangla & english worldwide

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

Muktir Upay : Rabindranath Tagore

মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ৩

নাটক
মুক্তির উপায়
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হৈমবতীর প্রবেশ
ফকির। কা তব কান্তা—
হৈমবতী। কী বকছ।
ফকির। কা তব কান্তা। কোন্ কান্তা হ্যায়।
হৈমবতা। হিন্দুস্থানী ধরেছ? বাংলায় বলো।
ফকির। বলি, কাঁদছে কে।
হৈমবতী। তোমারই মেয়ে মিন্তু।
ফকির। হায় রে, একেই বলে সংসার। কাঁদিয়ে ভাসিয়ে দিলে।
হৈমবতী। কাকে বলে সংসার।
ফকির। তোমাকে।
হৈমবতী। আর, তুমি কী! মুক্তির জাহাজ আমার! তোমরা বাঁধ না, আমরাই বাঁধি!
ফকির। গুরু বলেছেন, বাঁধন তোমাদেরই হাতে।
হৈমবতী। আমি তোমাকে যদি বেঁধে থাকি সাত পাকে, তোমার গুরু বেঁধেছেন সাতান্ন পাকে।
ফকির। মেয়েমানুষ— কী বুঝবে তুমি তত্ত্বকথা! কামিনী কাঞ্চন—
হৈম। দেখো, ভণ্ডামি কোরো না। কাঞ্চনের দাম তোমার গুরুজি কতখানি বোঝেন সে আমাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর, কামিনীর কথা বলছ! ঐ মূর্খ কামিনীগুলোই পায়ের ধুলো নিয়ে পায়ে কাঞ্চন যদি না ঢালত তা হলে তোমার গুরুজির পেট অত মোটা হত না। একটা খবর তোমাকে দিয়ে রাখি। এ বাড়ি থেকে একটা মায়া তোমার কাটবে। কাঞ্চনের বাঁধন খসল তোমার। শ্বশুরমশায় আমাকে দিব্যি গালিয়ে নিয়েছেন, আমার মাসহারা থেকে তোমাকে এক পয়সাও আর দিত পারব না।
পুষ্পর প্রবেশ
পুষ্প। ফকিরদা! মানে কী। তোমার শোবার ঘর থেকে পাওয়া গেল মাণ্ডূক্যোপনিষৎ! অনিদ্রার পাঁচন না কি!
ফকির। (ঈষৎ হেসে) তোমরা কী বুঝবে— মেয়েমানুষ!
পুষ্প। কৃপা করে বুঝিয়ে দিতে দোষ কী!
ফকির হাস্যমুখে নীরব
হৈম। কী জানি ভাই, ওখানা উনি বালিশের নীচে রেখে রাত্তিরে ঘুমোন।
পুষ্প। বেদমন্ত্রগুলোকে তলিয়ে দেন ঘুমের তলায়। এ বই পড়তে গেলে যে তোমাকে ফিরে যেতে হবে সাতজন্ম পূর্বে।
ফকির। গুরুকৃপায় আমাকে পড়তে হয় না।
পুষ্প। ঘুমিয়ে পড়তে হয়।
ফকির। এই পুঁথি হাতে তুলে নিয়ে তিনি এর পাতায় পাতায় ফুঁ দিয়ে দিয়েছেন, জ্বলে উঠেছে এর আলো, মলাট ফুঁড়ে জ্যেতি বেরতে থাকে অক্ষরের ফাঁকে ফাঁকে, ঢুকতে থাকে সুষুম্না নাড়ির পাকে পাকে।
পুষ্প। সেজন্যে ঘুমের দরকার?
ফকির। খুবই। আমি স্বয়ং দেখেছি গুরুজিকে, দুপুরবেলা আহারের পর ভগবদগীতা পেটের উপর নিয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়— গভীর নিদ্রা। বারণ করে দিয়েছেন সাধনায় ব্যাঘাত করতে। তিনি বলেন, ইড়াপিঙ্গলার মধ্য দিয়ে শ্লোকগুলো অন্তরাত্মায় প্রবেশ করতে থাকে, তার আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যায়। অবিশ্বাসীরা বলে, নাক ডাকে। তিনি হাসেন; বলেন, মূঢ়দের নাক ডাকে, ইড়াপিঙ্গলা ডাকে জ্ঞানীদের— নাসারন্ধ্র আর ব্রহ্মরন্ধ্র ঠিক এক রাস্তায়, যেন চিৎপুর আর চৌরঙ্গী।
পুষ্প। ভাই হৈমি, ফকিরদার ইড়াপিঙ্গলা আজকাল কী রকম আওয়াজ দিচ্ছে।
হৈম। খুব জোরে। মনে হয়, পেটের মধ্যে তিনটে চারটে ব্যাঙ মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ফকির। ঐ দেখো, শুনলে পুষ্পদিদি? আশ্চর্য ব্যাপার! সত্যি কথা না জেনেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। গুরুজি বলে দিয়েছেন, মাণ্ডূক্য উপনিষদের ডাকটাই হচ্ছে ব্যাঙের ডাক। অন্তরাত্মা চরম অবস্থায় নাভীগহ্বরে প্রবেশ করে হয়ে পড়েন কূপমণ্ডূক, চার দিকের কিছুতেই আর নজর পড়ে না। তখনি পেটের মধ্যে কেবলই শিবোহং শিবোহং শিবোহং করে নাড়িগুলো ডাক ছাড়তে থাকে। সেই ঘুমেতে কী গভীর আনন্দ সে আমিই জানি— যোগনিদ্রা একেই বলে।
হৈম। একদিন মিন্তু কেঁদে উঠে ওঁর সেই ব্যাঙডাকা ঘুম ভাঙিয়ে দিতেই তাকে মেরে খুন করেন আর কি!
পুষ্প। ফকিরদা, সংস্কৃতে অনার্স নিয়েছিলুম, আমাকে পড়তে হয়েছিল মাণ্ডূক্যের কিছু কিছু। নাকের মধ্যে গোলমরিচের গুঁড়ো দিয়ে হেঁচে হেঁচে ঘুম ভাঙিয়ে রাখতে হত। হাঁচির চোটে নিরেট ব্রহ্মজ্ঞানের বারো আনা তরল হয়ে নাক দিয়েই বেরিয়ে গিয়েছিল। ইড়াপঙ্গলা রইল বেকার হয়ে। অভাগিনী আমি, গুরুর ফুঁয়ের জোরে অজ্ঞানসমুদ্র পার হতে পারলেম না।
ফকির। (ঈষৎ হেসে) অধিকারভেদ আছে।
পুষ্প। আছে বই কি। দেখো-না, ঐ শাস্ত্রেই ঋষি কোন্-এক শিষ্যকে দেখিয়ে বলেছেন, সোয়মাত্মা চতুষ্পাৎ— এর আত্মাটা চার-পা-ওয়ালা। অধিকারভেদকেই তো বলে দু-পা চার-পায়ের ভেদ। হৈম, রাত্রে তো ব্যাঙের ডাক শুনে জেগে থাকিস, আর কোনো জাতের ডাক শুনিস কি দিনের বেলায়।
হৈম। কী জানি ভাই, মিন্তু দৈবাৎ ওঁর মন্ত্রপড়া জলের ঘটি উলটিয়ে দিতেই উনি যে হাঁক দিয়ে উঠেছিলেন সেটা—
পুষ্প। হাঁ, সেটা চারপেয়ে ডাক। মিলছে এই শাস্ত্রের সঙ্গে।
ফকির। সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।
পুষ্প। ফকিরদা, তপস্যা যখন ভেঙেছিল শিব এসেছিলেন তাঁর বরদাত্রীর কাছে— তোমার তপস্যা এবার গুটিয়ে নাও; এই দেখো, বরদাত্রী অপেক্ষা করে আছেন লালপেড়ে শাড়িখানি পরে।
হৈমবতী। পুষ্পদিদি, বরদাত্রীর জন্যে ভাবনা নেই; পাড় দেখা দিচ্ছে রঙ-বেরঙের।
পুষ্প। বুঝেছি, গেরুয়া রঙের ছটা বুঝি ঘরের দেয়াল পেরিয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে?
হৈমবতী। এরই মধ্যে আসতে আরম্ভ করেছেন দুটি একটি করে বরদাত্রী। গেরুয়া রঙের নেশা মেয়েরা সামলাতে পারে না। পোড়াকপালীদের মরণদশা আর কি! সেদিন এসেছিল একজন বেহায়া মেয়ে ওঁর কাছে মুক্তিমন্ত্র নেবে ব’লে। হবি তো হ, আমারই ঘরে এসে পড়েছিল— দুটো-একটা খাঁটি কথা শুনিয়েছিলুম, মুক্তিমন্ত্রেরই কাজ করেছিল, গেল মাথা ঝাঁকানি দিয়ে বেরিয়ে।
ফকির। দেখো, আমার মাণ্ডূক্যটা দাও।
পুষ্প। কী করবে।
ফকির। নারীর হাত লেগেছে, গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে আনিগে।
পুষ্প। সেই ভালো, বুদ্ধি দিয়ে ধোওয়াটা তো হল না এ জন্মে।
ফকির। শুনে যাও, হৈম। আজকে গুরুগৃহে নবরত্নদান ব্রত। আমি তাঁকে দেব সোনা, একটা গিনি চাই।
হৈমবতী। দিতে পারব না, শ্বশুরমশায় পা ছুঁইয়ে বারণ করেছেন।
পুষ্প। তোমার গুরুজির বুঝি কাঞ্চনে অরুচি নেই!
ফকির। তাঁর মহিমা কী বুঝবে তোমরা! কাঞ্চন পড়তে থাকে তাঁর ঝুলির মধ্যে আর তিনি চোখ বুজে বলেন— হুং ফট্।
বাস্, একেবারে ছাই হয়ে যায়। যারা তাঁর ভক্ত তাদের এ স্বচক্ষে দেখা।
পুষ্প। ঝুলিতে যদি ছাই ভরবারই দরকার থাকে, কাঠের ছাই আছে, কয়লার ছাই আছে, সোনার ছাই দিয়ে বোকামি কর কেন।
ফকির। হায় রে, এইটেই বুঝলে না! গুরুজি বলেছেন, মহাদেবের তৃতীয় নেত্রে দগ্ধ হয়েছিলেন কন্দর্প, সোনার আসক্তি ছাই করতেই গুরুজির আবির্ভাব ধরাধামে। স্থূল সোনার কামনা ভস্ম করে কানে দেবেন সূক্ষ্ম সোনা, গুরুমন্ত্র।
পুষ্প। আর সহ্য হচ্ছে না, চল্ ভাই হৈমি, তোর পড়া বাকি আছে।
ফকির। সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।
পুষ্প। (খানিক দূরে গিয়ে ফিরে এসে) রোসো ভাই, একটা কথা আছে, বলে যাই। ফকিরদা, শুনেছি তোমার গুরু আমার সঙ্গে একবার দেখা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
ফকির। হাঁ, তিনি শুনেছেন, তুমি বেদান্ত পাস করেছ। তিনি আমাকে বলে রেখেছেন, নিশ্চয় তোমাকে তাঁর পায়ে এসে পড়তে হবে, বেদান্ত যাবে কোথায় ভেসে! সময় প্রায় হয়ে এল।
পুষ্প। বুঝতে পারছি। কদিন ধরে কেবলই বাঁ চোখ নাচছে।
ফকির। নাচছে? বটে! ঐ দেখো, অব্যর্থ তাঁর বাক্য। টান ধরেছে।
পুষ্প। কিন্তু আগে থাকতে বলে রাখছি, ছাই করে দেবার মতো মালমসলা আমার মধ্যে বেশি পাবেন না। যা ছিল সব পাস করতে করতে য়ুনিভার্সিটির আঁস্তাকুড়ে ভর্তি করে দিয়েছি।
হৈমবতী। কী বলছ ভাই, পুষ্পদিদি! কোন্ ভূতে আবার তোমাকে পেল।
পুষ্প। কী জানি ভাই, দেশের হাওয়ায় এটা ঘটায়। বুদ্ধিতে কাঁপন দিয়ে হঠাৎ আসে যেন ম্যালেরিয়ার গুরুগুরুনি। মনে হচ্ছে, রবি ঠাকুরের একটা গান শুনেছিলুম—
গেরুয়া ফাঁদ পাতা ভুবনে,
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!
ফকির। পুষ্পদি, তুমি যে এতদূর এগিয়েছ তা আমি জানতুম না। পূর্বজন্মের কর্মফল আর কি!
পুষ্প। নিশ্চয়ই, অনেক জন্মের অবুদ্ধিকে দম দিতে দিতে এমন অদ্ভূত বুদ্ধি হঠাৎ পাক খেয়ে ওঠে— তার পরে আর রক্ষে নেই।
ফকির। উঃ, আশ্চর্য! ধন্য তুমি! সংসারে কেউ কেউ থাকে যাকে একেবারেই— কী বলব!
পুষ্প। একেবারে শেষের দিক থেকেই শুরু করে। রবি ঠাকুর বলেছেন—
যখন জাগিলে বিশ্বে পূর্ণপ্রস্ফুটিতা
ফকির। বা বা, বেশ বলেছেন রবি ঠাকুর— আমি তো কখনো পড়ি নি!
পুষ্প। ভালো করেছ, পড়লে বিপদেই পড়তে। ভাই হৈমি, তোর সেই মটরদানার দুনলী হারটা আমাকে দে দেখি। মহাপুরুষদের দর্শনে খালি হাতে যেতে নেই।
হৈম। কী বল, দিদি! ও যে আমার শাশুড়ির দেওয়া!
পুষ্প। এ মানুষটিও তো তোর শাশুড়ির দেওয়া, এও যেখানে তলিয়েছে ওটাও সেখানে যাবে নাহয়।
ফকির। অবোধ নারী, আসক্তি ত্যাগ করো, গুরুচরণে নিবেদন করো যা কিছু আছে তোমার।
পুষ্প। হৈমি, বিশ্বাস করে দাও আমার হাতে, লোকসান হবে না।
ফকির। আহা, বিশ্বাস— বিশ্বাসই সব! আমার ছোটো ছেলেটার নাম দেব— অমূল্যধন বিশ্বাস।
পুষ্প। হৈমি, ভয় নেই, আমার সাধনা হারাধন ফেরানো। গুরুকৃপায় সিদ্ধিলাভ হবে।

সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী

About The Author

সম্পাদক

Jebunnahar Joni

জেবুননাহার জনি। Jebunnahar joni. কবি ও গল্পকার। জন্ম : ১১ জানুয়ারি, নারায়ণগঞ্জ; পৈতৃকনিবাস মাদারীপুর। পিতা : আতাউর রহমান হাওলাদার, মাতা : নুরুননাহার খান। সমাজকল্যাণে বিএ সম্মানসহ এমএ। পেশা : শিক্ষকতা। লেখার বিষয় : কবিতা ও গল্প। প্রকাশিত গ্রন্থ : মেঘলা রাতে চাঁদ (গল্প, ২০০৭), বিরান পথের কাশবন (কবিতা, ২০১৭)। পুরস্কার : গাংচিল সাহিত্য পুরস্কার (২০১১), সমধারা সাহিত্য পুরস্কার (২০১৫)।