নাটক
মুক্তির উপায় : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১
ভূমিকা
ফকির, স্বামী অচ্যুতানন্দের চেলা। গোঁফদাড়িতে মুখের বারো-আনা অনাবিস্কৃত। ফকিরের স্ত্রী হৈমবতী। বাপের আদরের মেয়ে। তিনি টাকা রেখে গেছেন ওর জন্যে। ফকিরের বাপ বিশ্বেশ্বর পুত্রবধূকে স্নেহ করেন, পুত্রের অপরিমিত গুরুভক্তিতে তিনি উৎকণ্ঠিত।
পুষ্পমালা এম. এ. পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হওয়া মেয়ে। দূরসম্পর্কে হৈমর দিদি। কলেজি খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে পাড়াগাঁয়ে বোনের বাড়িতে সংসারটাকে প্রত্যক্ষ দেখতে এসেছে। কৌতূহলের সীমা নেই। কৌতুকের জিনিসকে নানা রকমে পরখ করে দেখতে কখনো নেপথ্যে, কখনো রঙ্গভূমিতে। ভারি মজা লাগছে। সকল পাড়ায় তার গতিবিধি, সকলেই তাকে ভালোবাসে।
পুষ্পমালার একজন গুরু আছেন, তিনি খাঁটি বনস্পতি জাতের। অগুরুজঙ্গলে দেশ গেছে ছেয়ে। পুষ্পর ইচ্ছে সেইগুলোতে হাসির আগুন লাগিয়ে খাণ্ডবদাহন করে। কাজ শুরু করেছিল এই নবগ্রামে। শুনেছি, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর পুণ্যকর্মে ব্যাঘাত ঘটেছে। তার পর থেকে পঞ্চশরের সঙ্গে হাসির শর যোগ করে ঘরের মধ্যেই সুমধুর অশান্তি আলোড়িত করেছে। সেই প্রহসনটা এই প্রহসনের বাইরে।
পাশের পাড়ার মোড়ল ষষ্ঠীচরণ। তার নাতি মাখন দুই স্ত্রীর তাড়ায় সাত বছর দেশছাড়া। ষষ্ঠীচরণের বিশ্বাস পুষ্পর অসামান্য বশীকরণ-শক্তি। সেই পারবে মাখনকে ফিরিয়ে আনতে। পুষ্প শুনে হাসে আর ভাবে, যদি সম্ভব হয় তবে প্রহসনটাকে সে সম্পূর্ণ করে দেবে। এই নিয়ে রবি ঠাকুর নামে একজন গ্রন্থকারের সঙ্গে মাঝে মাঝে সে পত্রব্যবহার করেছে।
মুক্তির উপায়
প্রথম দৃশ্য
ফকির। পুষ্পমালা। হৈমবতী
ফকির। সোহং সোহং সোহং।
পুষ্প। ব’সে ব’সে আওড়াচ্ছ কী।
ফকির। গুরুমন্ত্র।
পুষ্প। কতদূর এগোল।
ফকির। এই, ইড়া নাড়িটার কাছ পর্যন্ত এসে গেল থেমে।
পুষ্প। হঠাৎ থামে কেন।
ফকির। ঐ আমার ছিঁচকাঁদুনি খুকিটার কীর্তি। মন্তরটা গুরগুর গুরগুর করতে করতে দিব্যি উঠেছিল উপরের দিকে ঠেলে। বোধ হয় আর সিকি ইঞ্চি হলেই পিঙ্গলার মধ্যে ঢুকে পড়ত, এমন সময় মেয়েটা নাকিসুরে চীৎকার করে উঠল— বাবা, নচঞ্চুস্। দিলুম ঠাস করে গালে এক চড়, ভ্যাঁ করে উঠল কেঁদে, অমনি এক চমকে মন্তরটা নেমে পড়ল পিঙ্গলার মুখ থেকে একেবারে নাভীগহ্বর পর্যন্ত। সোহং ব্রহ্ম, সোহং ব্রহ্ম।
পুষ্প। তোমার গুরুর মন্তরটা কি অজীর্ণরোগের মতো। নাড়ির মধ্যে গিয়ে—
ফকির। হাঁ দিদি, নাড়ির মধ্যে ঘুটঘাট ঘুটঘাট করছেই— ওটা বায়ু কিনা।
পুষ্প। বায়ু নাকি।
ফকির। তা না তো কী। শব্দব্রহ্ম— ওতে বায়ু ছাড়া আর কিছুই নেই। ঋষিরা যখন কেবলই বায়ু খেতেন তখন কেবলই বানাতেন মন্তর।
পুষ্প। বল কী।
ফকির। নইলে অতটা বায়ু জমতে দিলে পেট যেত ফেটে। নাড়ী যেত পটপট করে ছিঁড়ে বিশখানা হয়ে।
পুষ্প। উঃ, তাই তো বটে— একেবারে চার-বেদ-ভরা মন্ত্র— কম হাওয়া তো লাগে নি।
ফকির। শুনলেই তো বুঝতে পার, ঐ-যে ও—ম্, ওটা তো নিছক বায়ু উদ্গার। পুণ্যবায়ু, জগৎ পবিত্র করে।
পুষ্প। এত সব জ্ঞানের কথা পেলে কোথা থেকে। আমরা হলে তো পাগল হয়ে যেতুম।
ফকির। সবই গুরুর মুখ থেকে। তিনি বলেন, কলিতে গুরুর মুখই গোমুখী— মন্ত্রগঙ্গা বেরচ্ছে কল্কল্ করে।
পুষ্প। বি. এ. তে সংস্কৃতে অনার্স নিয়ে খেটে মরেছি মিথ্যে। অজীর্ণ রোগেও ভুগেছি, সেটা কিন্তু পাকযন্ত্রের, ইড়াপিঙ্গলার নয়।
ফকির। এতেই বুঝে নাও— গুরুর কৃপা। তাই তো আমার নাড়ির মধ্যে মন্তরটা প্রায়ই ডাক ছাড়ে গুরু গুরু গুরু শব্দে।
পুষ্প। আচ্ছা, ডাকটা কি আহারের পরে বাড়ে।
ফকির। তা বাড়ে বটে।
পুষ্প। গুরু কী বলেন।
ফকির। তিনি বলেন, পেটের মধ্যে স্থূলে সূক্ষ্মে লড়াই, যেন দেবে দৈত্যে। খাদ্যের সঙ্গে মন্ত্রের বেধে যায় যেন গোলাগুলি-বর্ষণ, নাড়িগুলো উচ্চস্বরে গুরুকে স্মরণ করতে থাকে।
হৈম। দুঃখের কথা আর কী বলব দিদি, পেটের মধ্যে গুরুর স্মরণ চলছে, বাইরেও বিরাম নেই। চরণদাস বাবাজি আছেন ওঁর গুরুভাই, সে লোকটার দয়ামায়া নেই, ওঁকে গান শেখাচ্ছেন। পাড়ার লোকেরা—
পুষ্প। চুপ চুপ চুপ, পতিব্রতা তুমি। স্বামীর কণ্ঠ যখন চলে, সাধ্বীরা প্রাণপণে থাকেন নীরবে। ফকিরদা, গলায় গান শানাচ্ছ কেন, গান্ধিজির অহিংসানীতির কথা শোন নি।
হৈম। তোমরা দুজনে তত্ত্বকথা নিয়ে থাকো। আমাকে যেতে হবে মাছ কুটতে। আমি চললুম।
[ প্রস্থান
ফকির। আমার কথাটা বুঝিয়ে বলি। গুরুর মন্ত্র, যাকে বলে গুরুপাক। খুব বেশি যখন জমে ওঠে অন্তরে, তখন সমস্ত শরীরটা ওঠে পাক দিয়ে; নাচের ঘূর্ণি উঠতে থাকে পায়ের তলা থেকে উপরের দিকে; আর, ঘানি ঘুরলে যেরকম আওয়াজ দিতে চায়, ভক্তির ঘোরে সেইরকম গানের আওয়াজ ওঠে গলার ভিতর দিয়ে। এই দেখো-না এখনি সাধনার নাড়া লেগেছে একেবারে মূলাধার থেকে—উঃ!
পুষ্প। কী সর্বনাশ! ডাক্তার ডাকব নাকি।
ফকির। কিছু করতে হবে না। একবার পেট ভরে নেচে নিতে হবে। গুরু বলেছেন, গুরুর মন্ত্রটা হল ধারক, আর নৃত্যটা হল সারক, দুটোরই খুব দরকার। (উঠে দাঁড়িয়ে নৃত্য)
গুরুচরণ করো শরণ-অ
ভবতরঙ্গ হবে তরণ-অ
সুধাক্ষরণ। প্রাণভরণ-অ
মরণ-ভয় হবে হরণ-অ।
পুষ্প। শুধু মরণভয়-হরণ নয়, দাদা। গুরুদক্ষিণার চোটে স্ত্রীর গয়না,বাপের তহবিল হরণও চলছে পুরো দমে।
ফকির। ঐ দেখো, বাবা আসছেন বউ কে নিয়ে। বড়ো ব্যাঘাত, বড়ো ব্যাঘাত। গুরো।
পুষ্প। ব্যাঘাতটা কিসের।
ফকির। স্থূলরূপে ওঁরা আমাকে ফকির বলেই জানেন।
পুষ্প। আরো একটা রূপ আছে না কি।
ফকির। ক্ষয় হয়ে গেছে আমার ফকির-দেহটা ভিতরে ভিতরে। কেবলই মিলে যাচ্ছে গুরুদেহের সূক্ষ্মরূপে। বাইরে পড়ে আছে খোলসটা মাত্র। ওঁরা আসলটাকে কিছুতেই দেখবেন না।
পুষ্প। খোলসটা যে অত্যন্ত বেশি দেখা যাচ্ছে। একেবারেই স্বচ্ছ নয়।
ফকির। দৃষ্টিশুদ্ধি হতে দেরি হয়। কিন্তু সব আগে চাই বিশ্বাসটা। ভগবৎ-কৃপায় এঁদের মনে যদি কখনো বিশ্বাস জাগে, তা হলে গুরুদেহে আর ফকিরের দেহে একেবারে অভেদ রূপ দেখতে পাবেন— তখন বাবা—
পুষ্প। তখন বাবা গয়ায় পিণ্ডি দিতে বেরবেন।
[ফকিরের প্রস্থান]
সূত্র : রবীন্দ্র রচনাবলী
সংশ্লিষ্ট আরো লেখা...
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৫১-১৫৭
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪৬-১৫০
গীতাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ১৪১-১৪৫